পলিথিন-ত্রিপলে মাথা গোঁজার ঠাঁই মেরামতের চেষ্টা ক্ষতিগ্রস্তদের

0
199

টেকনাফ পৌর এলাকার কুলালপাড়া জিপ স্টেশন মোড় থেকে শাহপরীর দ্বীপ জেটি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটারের পথ। সেই জেটি থেকে জালিয়াপাড়া বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল নাফ নদীর বাজারপাড়া ঘাটে নোঙর করা শতাধিক মাছ ধরার ট্রলার। ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে।

নাফ নদীর তীরঘেঁষা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশ জালিয়াপাড়া। প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ দিয়ে সামনে যেতে দেখা গেল জালিয়াপাড়া এলাকায় ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘর ও দোকানপাট। অধিকাংশ ঘরের চালা ও বেড়া উড়ে গেছে। বাঁধের ওপরে কিছু জেলে নৌকার জাল মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এ ইউনিয়নে অন্তত দুই হাজার পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছে। এখনো সরকারি কোনো ত্রাণসামগ্রী পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি এনজিও সংস্থার মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
শামসুল আলম, প্যানেল চেয়ারম্যান, সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদ

জালিয়াপাড়া পানির ট্যাংক পর্যন্ত গিয়ে দেখা গেল, নিজের বিধ্বস্ত দোকানের সামনে বসে আছেন বশির আহমদ (৫৫)। তিনি বললেন, ‘ঘরবাড়ি ও দোকান সব ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গেছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই। গত রাতে (মঙ্গলবার) বৃষ্টির সময় পরিবারের লোকজনসহ খুবই কষ্ট করেছি। জানি না, কবে নাগাদ দোকান ও ঘরটি ঠিক করতে পারব।’ তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় তাঁর দোকানের প্রায় ৩০ হাজার টাকার মালামাল লুট হয়েছে। এখন প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া খাদ্যসহায়তা পেয়ে কোনোরকমে দিন যাপন করছেন।

শুধু বশির আহমদ নন, গতকাল বুধবার দুপুরের পর সরেজমিনে দেখা গেল, ভাঙা ঘর পলিথিন বা ত্রিপল টাঙিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ পরিবার নিয়ে বসে ছিলেন খোলা আকাশের নিচে।

জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা গৃহবধূ ফাতেমা খাতুন (৩৭)। স্বামী মোহাম্মদ জোবায়ের দিনমজুর। কিন্তু কাজে না গিয়ে বিধ্বস্ত ঘরে কোনোরকমে থাকার ব্যবস্থা করার চেষ্টায় ব্যস্ত তিনি। আবার কাজে না গেলে খাবার জুটবে কি না, সেই শঙ্কাও রয়েছে তাঁদের।

একই এলাকার গৃহবধূ আয়েশা বেগম (৫০) বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে ঘর তছনছ হয়ে গেছে। মেরামত করতে টাকা লাগবে। ঘর ঠিক করব কীভাবে, সেই চিন্তা করছি।’ ওই নারী বলছিলেন, ১১ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। তাই ছেলের সঙ্গে থাকেন। ছেলের স্ত্রী–সন্তান মিলে সাত সদস্যের পরিবার। ছেলে আমির হোসেন মাছ ধরে সংসার চালান। তুফানের (ঘূর্ণিঝড়) কারণে মাছ ধরা বন্ধ। তুফানের তিন দিন পরও কোনো ত্রাণ পাননি।

ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শাহপরীর দ্বীপের তিনটি ওয়ার্ডের কয়েকটি গ্রাম। সরেজিমনে দেখা গেল, অনেকেরই বসতঘর প্রায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। এঁদের বেশির ভাগই জেলে ও দিনমজুর। তাঁরা ঘর মেরামতের জন্য সহায়তা চান।

ঘরের চাল উড়ে যাওয়ায় চালার জায়গায় পলিথিন দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন জেলে নূর কবির ও পরিবারের সাত সদস্য। মঙ্গলবার রাতে বৃষ্টি এলে পলিথিনের নিচে রাত কাটানো হলেও কেউ ঘুমাতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘এই ঘর কীভাবে মেরামত করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এ ছাড়া শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, ক্যাম্প পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, মাঝের পাড়া, ডাঙ্গর পাড়া ও উত্তর পাড়া এলাকায়ও কঠিন আঘাত হেনেছে। নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ড নিয়ে (৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড) গঠিত এই শাহপরীর দ্বীপের লোকসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এ ছাড়া শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, ক্যাম্প পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, মাঝের পাড়া, ডাঙ্গর পাড়া ও উত্তর পাড়া এলাকায়ও কঠিন আঘাত হেনেছে।

বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে দক্ষিণ পাড়ায় ঢুকতেই দেখা গেল আমির হোসেনের (৪৫) বসতঘর। ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ঘরটির চালা দুমড়েমুচড়ে গেছে। এখন ছেলেরা মিলে পলিথিন দিয়ে কোনোরকমে থাকার চেষ্টা করছেন। ত্রাণ হিসেবে এখনো কিছু পাননি।

শাহপরীর দ্বীপে মাঝের পাড়া, ডাঙ্গর পাড়া ও উত্তর পাড়া ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। যে যাঁর মতো করে এসব ঘর মেরামতের চেষ্টা করছেন।

ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ও তার ছিঁড়ে যাওয়ায় শাহপরীর দ্বীপ গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন ছিল। এ দ্বীপে ৪০ হাজার মানুষের বাস। সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে এখানকার মানুষ খাবার ও পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পায়নি। এরপরও বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম চলছে। এলাকায় চার দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই।’

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, এ ইউনিয়নে অন্তত দুই হাজার পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছে। এখনো সরকারি কোনো ত্রাণসামগ্রী পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি এনজিও সংস্থার মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

ত্রাণসহায়তা

শাহপরীর দ্বীপের মাঝের পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, ডাঙ্গর পাড়া পরিদর্শন শেষে দুই শতাধিক পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। গতকাল বুধবার দুপুরে এসব এলাকা পরিদর্শনের সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলেছি। পাশাপাশি কিছু খাদ্যসামগ্রী সহায়তা দিয়েছি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সঠিক তালিকা প্রস্তুত করে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হবে।’

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য গতকাল ত্রাণসহায়তা ও ঘর মেরামতের জন্য ঢেউটিন পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য তালিকা করা হচ্ছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনের ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ২০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ শুরু করা হয়েছে। শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দাদেরও ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য ঢেউটিন ও নগদ অর্থ দেওয়া হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.