দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। হিন্দু আইন অনুযায়ী পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নেই। এমনকি বিয়েবিচ্ছেদের অধিকারও নেই স্ত্রীর। সন্তানের অভিভাবকত্ব ও অধিকারও আইন অনুযায়ী স্বামীকে দেওয়া হয়েছে। এসব বৈষম্য দূর করতে দেশে প্রচলিত হিন্দু আইন সংস্কারে দাবি বিভিন্ন মহলের। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের নেতাদের বিরোধিতায় আইন সংস্কারের দাবি এখনও উপেক্ষিত রয়েছে। বিষয়টি শেষ অবধি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। দেশের বৌদ্ধ নারীরাও হিন্দু আইন অনুযায়ী পরিচালিত হন। এতে আশার আলো দেখছেন বঞ্চনার শিকার হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নারীরা।
হিন্দু নারীদের আইনগত অধিকার নিশ্চিতের প্রশ্নে গত ১৪ মে হাইকোর্টে রিট করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্টসহ ৯টি সংগঠন। পরে ওই রিটের শুনানি নিয়ে হিন্দু নারীদের বিয়েবিচ্ছেদের অধিকার, বিয়ে নিবন্ধন, ব্যবস্থাপনা, অভিভাবকত্ব, সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার প্রদানে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না– তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলের পর হিন্দু আইন সংশোধনের বিষয়ে ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠনের দাবি আবারও জোরালো হয়ে উঠেছে।
এর আগে ২০১৭ সালে আইন কমিশন থেকে পিতার সম্পত্তিতে মেয়ের সমান অধিকার দেওয়া এবং বিয়েবিচ্ছেদের সুযোগ রাখাসহ হিন্দু আইন সংস্কারের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবসহ সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের বিভক্তির কারণে পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, বিদ্যমান হিন্দু আইনটি পক্ষপাতমূলক। এ আইনের মাধ্যমে হিন্দু নারীদের নানাভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। একই বাবার ঔরসজাত সন্তান হয়েও ছেলেরা সম্পত্তি পাবে আর মেয়েরা পাবে না–এ ধারণা বর্তমান যুগে অচল। অবশ্যই হিন্দু আইন সংস্কার হওয়া দরকার। হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন। একে স্বাগত জানাই।
আইন সংশোধন না হওয়া প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, হিন্দু নারীদের নিরাপত্তাহীন করে রাখাই এর উদ্দেশ্য। কেউ কেউ যুক্তি দেন, নারীদের সম্পত্তি দেওয়া হলে তাঁরা ধর্মান্তরিত হয়ে যাবেন। তাঁর মতে, এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। কারণ, বিশ্বে সব ধর্মেই ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এর পরও কেউ যদি ধর্মান্তরিত হন তাঁর ক্ষেত্রে আইনে বলা যেতে পারে, তিনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার বিষয়টি অবসান হওয়া প্রয়োজন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নারীরা হিন্দু আইন অনুযায়ী পরিচালিত হন। তাই হিন্দু নারীদের অধিকার প্রশ্নে হাইকোর্ট যে বিষয়গুলোতে রুল জারি করেছেন, তা ইতিবাচক। কারণ, হিন্দু আইন সংশোধন প্রশ্নে দুটি পক্ষ রয়েছে। কেউ চান সংশোধন হোক, আবার এক পক্ষ এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। তাই আশা করছি, হাইকোর্টের রায়ে ইতিবাচক কিছু অগ্রগতি ঘটবে। তা ছাড়া হিন্দু নারীদের বিয়ে, বিচ্ছেদসহ নানা বিষয়েও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন।
অবশ্য হিন্দু আইন সংস্কার বা সংশোধন যা-ই হোক, এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক। তিনি বলেন, হিন্দু আইন ধর্ম পালনের একটি অংশ। বিয়ে, সম্পত্তি, অভিভাবকত্বসহ যে বিষয়গুলো নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন– তা সবই ধর্মের অংশ। ধর্মের স্বতঃসিদ্ধ বিষয়ে হাইকোর্টের কিছু করার নেই। যদি করা হয়, তাহলে হিন্দু ধর্মের ওপর তা হবে সরাসরি আঘাত হানার শামিল। আমরা হাইকোর্টে এ বিষয়ে শুনানিতে পক্ষভুক্ত হয়ে জবাব দেব। হিন্দু সমাজ কখনও হিন্দু আইন সংশোধনের বিষয়টি মেনে নেবে না। তাঁর মতে, ধর্মের ভিত্তিতে প্রণীত বিধিবিধান ক্ষুণ্ন করা হলে নারীরাও অরক্ষিত হবেন এবং পরিবার বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি অসহায় হয়ে যাবেন।
হিন্দু আইন সংশোধনের বিষয়ে কয়েকজন হিন্দু নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা গণমাধ্যমে পরিচয় দিতে চাননি। একজন চিকিৎসক নারী বলেছেন, পরিচয় প্রকাশ হলে সংসারে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা রয়েছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের এক গৃহিণী বলেন, হাইকোর্ট হিন্দু নারীর অধিকার প্রশ্নে ইতিবাচক রায় দেবেন। কারণ, আমরা অধিকারবঞ্চিত। শুধু রায় দিলেই হবে না, সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা রায় কার্যকর করবেন– এটিও প্রত্যাশা করছি। এটি আমাদের ন্যায্য দাবি।
হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক বলেন, লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে কারও প্রতি বৈষম্য করা সংবিধানবিরোধী। ভারত ও নেপালে হিন্দু আইন অনুযায়ী নারীরা সমানাধিকার পান। তাহলে আমাদের দেশে কেন নারীরা এখনও বঞ্চিত হবেন– এটি সবারই ভেবে দেখা দরকার। তিনি জানান, ১৯৪৬ সালের পর আর কখনও হিন্দু আইন সংশোধন করা হয়নি। ফলে হিন্দু আইনের অনেক বিষয় এখন অকার্যকর হয়ে গেছে। তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবিলম্বে হিন্দু আইনের নানা বিষয় সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এটি হলে হিন্দু নারীদের অধিকার প্রশ্নে নানা বিরোধের অবসান হবে এবং আদালতে বিচারাধীন মামলাও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারাধীন। তাই এ নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।
আবু সালেহ রনি