আরবি পড়াতে গিয়ে কলেজছাত্রী রাবেয়া আক্তারকে ‘প্রতারণামূলকভাবে মৌখিক বিয়ে’ করেছিলেন সাইদুল ইসলাম। সেই ‘বিয়ের’ সামাজিক স্বীকৃতির জন্য রাবেয়ার পরিবারকে তিন বছর ধরে চাপ দিয়ে আসছিলেন তিনি। এরই মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন রাবেয়া। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করেন সাইদুল।
গাজীপুরে বাড়িতে ঢুকে কলেজছাত্রী রাবেয়া আক্তারকে (২১) হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি সাইদুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে র্যাব। ঘটনার এক দিন পর গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
বাসায় ঢুকে ছাত্রীকে কুপিয়ে হত্যা, আহত মা আইসিইউতে
গত সোমবার রাতে গাজীপুরের সালনা এলাকায় বাসায় ঢুকে কুপিয়ে কলেজছাত্রী রাবেয়া আক্তারকে হত্যা করা হয়। এ সময় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে রাবেয়ার মা ও তিন বোনকেও কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে তাঁর মাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় আজ সকালে তাঁকে সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়া হয়। ওই ঘটনায় নিহত রাবেয়ার বাবা আবদুর রউফ বাদী হয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটনের সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব বলছে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। র্যাব হত্যাকাণ্ডে জড়িত গৃহশিক্ষককে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১–এর একটি আভিযানিক দল টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের প্রধান ও একমাত্র আসামি সাইদুল ইসলামকে (২৫) গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার সাইদুল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থানার মহেশতারা গ্রামের বাসিন্দা।
পরিকল্পিত হত্যা
গ্রেপ্তার সাইদুল জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানান, রাবেয়াকে হত্যার পূর্বপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ৭ মে বিকেলে স্থানীয় বাজারে কামারের দোকানে ৬৫০ টাকা দিয়ে একটি ছুরি তৈরি করতে দেন। পরদিন ৮ মে সন্ধ্যায় ছুরি সংগ্রহ করে ওই কলেজছাত্রীর বাসায় গিয়ে তাঁর কক্ষে ঢুকে ধারালো ছুরি দিয়ে মাথায়, গলায়, হাতে এবং পায়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। এ সময় তাঁর চিৎকারে মা ও দুই বোন ছুটে এসে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। সাইদুল ছুরি দিয়ে তাঁদেরও এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে জখম করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।
পড়াতে গিয়ে ‘মৌখিক বিয়ে’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইদুল জানান, ২০২০ সালে করোনার সময় ওই ছাত্রীর পরিবারের সবাইকে আরবি পড়ানোর জন্য গৃহশিক্ষক হিসেবে সাইদুলকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই সুবাদে তিনি প্রতিনিয়ত রাবেয়াদের বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। একপর্যায়ে রাবেয়াদের পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। বিভিন্ন সময় সাইদুল কলেজছাত্রী রাবেয়ার দিকে কুনজর দেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন। পাঁচ-ছয় মাস আরবি শেখানোর পর পড়ানো বন্ধ করে দেন।
নিহত কলেজছাত্রীর বাবার প্রশ্ন, মানুষ মানুষরে এত নির্মমভাবে মারতে পারে?
র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সাইদুল প্রতারণামূলকভাবে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে কলেজছাত্রী রাবেয়া আক্তারকে মৌখিকভাবে বিয়ে করেন। পরে সাইদুল তাঁদের বিয়ের বিষয়টি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাবেয়া ও তাঁর পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে রাবেয়ার সঙ্গে গৃহশিক্ষক সাইদুলের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তাঁর পরিবার।
বিদেশযাত্রার খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে খুন
র্যাব বলছে, দুই মাস ধরে রাবেয়া কলেজে যাওয়া–আসার পথে আবারও সাইদুল তাঁকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। তাঁকে সামাজিকভাবে বিয়ে করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। রাবেয়াকে তাঁর পরিবার উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিষয়টি সাইদুল কোনোভাবেই মেনে নিতে না পেরে রাবেয়া ও তাঁর পরিবারের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
পরিবারের সূত্রে জানা যায়, রাবেয়া ২০২০ সালে জয়দেবপুরের একটি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরে গাজীপুরের চৌরাস্তার একটি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি প্রসাধনসামগ্রীর অনলাইন শপে চাকরি করতেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য কিছুদিন আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। ভিসাসহ আনুষঙ্গিক নথিপত্র প্রস্তুত করছিলেন রাবেয়া।
বিচার চান বাবা
হামলার পর গুরুতর আহত রাবেয়ার মা বিলকিছ বেগমকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজধানীর একটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। রাবেয়ার বাবা আবদুর রউফ জানান, আজ সকালে বিলকিছ বেগমকে আইসিইউ থেকে সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে। এখন তিনি আশঙ্কামুক্ত।
আবদুর রউফ বলেন, ‘মানুষ মানুষরে এত নির্মমভাবে মারতে পারে? আমি যদি কারও ঘরে গিয়ে একটা চা খাই; আমি তাদের সন্তানকে হত্যা করতে পারব? আমি তার (প্রাইভেট শিক্ষক সাইদুল ইসলাম) মা-বাবাকে অনেক বলেছি। কিন্তু ছেলেকে তারা সামলাতে পারে নাই। আমার মাইয়ার হত্যাকারীর বিচার চাই।’