ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর (৫৮) মৃত্যুর ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করেছেন তাঁর ছেলে ওয়াসিফ আহমেদ। তবে মোস্তাব আলীর ভাই ও ভাতিজা বলছেন, মোস্তাব আলীকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁরা ধারণা করছেন। মোস্তাব আলীর স্ত্রী ও সন্তান তাঁকে মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। এ ছাড়া মোস্তাব আলী ঋণে জর্জরিত ছিলেন। তাই মোস্তাব আলীর এ মৃত্যুর পেছনে তাঁর স্ত্রী-সন্তান কিংবা পাওনাদার রইজুল ইসলামের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
গতকাল বুধবার সকাল নয়টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরার ২ নম্বর লোকেশনের আবাসিক এলাকায় থেকে অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। শৌচাগারের ভেতরে গলায় রশি প্যাঁচানো অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করা হয়। নিহত মোস্তাব আলী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিরাসার বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর বাড়ি নাটোরে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে অধ্যক্ষের ভাতিজা আসিফ বিন আলী বলেন, ‘চাচার লাশ দেখার পর আমার সন্দেহের মাত্রা অনেক বেড়েছে। চাচা কলেজের অধ্যক্ষ থাকলেও পারিবারিকভাবে ভালো ছিলেন না। ঋণে জর্জরিত ছিলেন। কলেজের বেতনের সবটা দিয়ে প্রতি মাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতেন।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শৌচাগারে গলায় রশি প্যাঁচানো অবস্থায় পড়ে ছিল অধ্যক্ষের লাশ
আসিফ বিন আলীর দাবি, স্ত্রী-সন্তান তাঁকে (মোস্তাব আলী) মানসিক নির্যাতন করতেন। এর মধ্যে গতকাল বুধবার রাতে একটি ব্যাংক থেকে আবেদন করা ঋণের ছয় লাখ টাকা মোস্তাব আলীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছেছে। ওই টাকা মোস্তাব আলী তাঁর চাচাতো ভাই মোহাম্মদ রইজুল ইসলাম ওরফে রাজুকে দিতে চেয়েছিলেন। রইজুলের কাছ থেকে সুদের ওপর ছয় লাখ টাকা নিয়েছিলেন মোস্তাব আলী। গতকাল সকাল আটটার দিকে টাকা নিতে নাটোর থেকে চাচার কলেজেও গিয়েছিলেন রইজুল। মোস্তাব আলীর মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর স্ত্রী-সন্তান কিংবা রইজুলের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। তাই এ বিষয়ে তিনি যথাযথ তদন্তের দাবি জানান।
তবে রইজুল গতকাল বলেছিলেন, তিনি মোস্তাব আলীকে ঋণ দিয়েছিলেন, এটা সত্য। তবে মৃত্যুর সঙ্গে এ ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন তিনি।
নিহত অধ্যক্ষের ভাই নাটোরের পুঠিয়ার ঝলমলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তাঁর ভাই আত্মহত্যা করার মতো মানুষ ছিলেন না। তাঁর মৃত্যুর পেছনের কারণ উদ্ঘাটন করার জন্য পুলিশকে অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁর ভাইকে আত্মহত্যার প্ররোচনাও দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
পরিবার, সহকর্মী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বুধবার সকাল ৮টা ১২ মিনিটে গাড়িচালক জয়নাল আবেদীন মোল্লাকে ফোন করেন মোস্তাব আলী। জয়নালের সঙ্গে তাঁর ১৭ মিনিট কথা হয়। মুঠোফোনে চালককে ৯টার দিকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলেন। সকাল সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নয়টার দিকে অধ্যক্ষের ছেলে ওয়াসিফ আহমেদ নিরাপত্তাপ্রহরী জিয়াউল হককে একটি শাবল নিয়ে আসতে বলেন। পরে নিরাপত্তাপ্রহরী, গাড়িচালক ও তিনি (ওয়াসিফ) মিলে বাসার শৌচাগারের দরজা ভেঙে ঝরনার পাইপের সঙ্গে গলায় রশি প্যাঁচানো অবস্থায় অধ্যক্ষকে দেখতে পান। সেখান থেকে তাঁকে কক্ষের ভেতরে নিয়ে যান তাঁরা। খবর পেয়ে চিকিৎসক ঘটনাস্থলে পৌঁছে অধ্যক্ষকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সদর থানা-পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একজন প্রভাষক বলেন, ‘ছেলের ব্যবসার জন্য অধ্যক্ষ স্যার বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছেন। ছেলেটা স্যারকে মানসিক নির্যাতন করতেন।’
তবে মোস্তাব আলীর ছেলে ওয়াসিফ আহমেদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর বাবা ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা এবং কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ করেছিলেন। ঋণের কারণে তাঁর বাবা গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাফায়েত উল্লাহ বলেন, মোস্তাব আলী ঋণে জর্জরিত ছিলেন। পারিবারিকভাবেও ভালো ছিলেন না।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরানুল ইসলাম বলেন, অধ্যক্ষের মৃত্যুর বিষয়ে তাঁর ছেলে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। তবে মৃত্যুর ঘটনায় এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ দেননি।
এদিকে আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে নাটোর সদর উপজেলার পাইকপাড়ায় মোস্তাব আলীর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। এর আগে গতকাল বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে অধ্যক্ষের লাশ ছেলে ও সহকর্মীদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে তাঁর লাশ নিয়ে নাটোরের উদ্দেশে রওনা দেন তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও সহকর্মীরা।