‘শিকার স্মৃতি’ বইয়ে শত বছর আগের নানা রকম তথ্য আছে। তখন ময়মনসিংহ এলাকার আশপাশের জঙ্গলে চিতা বাঘ, বড় শিংয়ের হরিণ ছিল। মধুপুর জঙ্গলের এসব তথ্যসহ এ বইয়ে পাওয়া যাবে সেই সময়ের শিকারের রঙিন ছবি। তবে পৌনে ৪০০ পৃষ্ঠার বইয়ের ৩৫২তম পৃষ্ঠায় সাদাকালো হাতির সঙ্গে সহাবস্থান নিয়েছে সত্যিকারের উইপোকা। মুক্তাগাছার জমিদার শ্রী জিতেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর লেখা ‘শিকার স্মৃতি’ বইটি আছে বাংলা একাডেমির ‘মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি পাঠাগার’-এ। ৫০ বছর ধরে মূল্যবান সংগ্রহের এ পাঠাগার বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারের অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ১০ হাজার মূল্যবান বইয়ের এ সম্ভারের অস্তিত্ব একাডেমির অনেক কর্মকর্তাও জানেন না। এখন ভ্যাপসা অবস্থায় তালাবদ্ধ থাকতে থাকতে নষ্ট হচ্ছে বইয়ের পাতা। আছে পোকামাকড়ের উপদ্রব। কর্তৃপক্ষ বলছেন, প্রকল্প পাসের জন্য আটকে আছে সংরক্ষণের কাজ।
বাংলা একাডেমির পাঠাগার সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন সময়ে বই উপহার দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। কখনো নিজস্ব সংগ্রহের কয়েক শ উল্লেখযোগ্য বই, কখনো পুরো পাঠাগার। জাহানারা ইমাম, সিকান্দার আবু জাফর, রাজিয়া মজিদ, রশিদ করিম, মহাদেব সাহা অথবা আহমদ শরীফের ব্যক্তিগত পাঠাগারের একাংশ দেওয়া হয়েছে বাংলা একাডেমিকে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ হচ্ছে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির পাঠাগারটি। এখন একাডেমির নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় এ পাঠাগারের অবস্থান। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানে প্রবেশ করে দেখা গেল, ধুলার আস্তরণে ছেয়ে আছে বই এবং পুরো ঘর। ভেতরে পড়া বা বই দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। অপ্রতুল আলো। এ কক্ষে স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া কঠিন। বই শেষ কবে পরিষ্কার করা হয়েছে, বলতে পারেন না গ্রন্থাগারের কর্মচারীরা।
‘শিকার স্মৃতি’র মতোই অবস্থা পাঠাগারের শ্রী যতীন্দ্র মোহন রায় প্রণীত ১৩২২ বাংলা সনে প্রকাশিত ‘ঢাকার ইতিহাস’ অথবা রামপ্রাণ গুপ্তের অনুবাদে ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ গ্রন্থের। গত বছরের ৯ নভেম্বর এবং এ বছরের ২৮ মার্চ দুবার বাংলা একাডেমির মূল পাঠাগারের কর্তৃপক্ষের কাছে দেখতে চাওয়া হয় মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির পাঠাগারের বইয়ের তালিকাটি। কোনোবারই তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ধুলা সরিয়ে কয়েকটি শেলফে তাকালে দেখা যায়, পাঠাগারে আছে উনিশ শতকে প্রকাশিত মালিক মুহম্মদ জয়শ্রীর উর্দু ভাষার ‘পদ্মাবতী’, দীনেশ চন্দ্র সেনের বৈদিক ভারত, শত বছরের পুরোনো পঞ্জিকার সংকলনের মতো মূল্যবান সংগ্রহ। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার পৃষ্ঠার ‘পদ্মাবতী’ বইটির প্রতি পৃষ্ঠায় রয়েছে আঁকা ছবি। এখানকার একটি দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ ‘রেনেলস বেঙ্গল এটলাস’। মেজর জেমস রেনেলের তৈরি ১৭৮৩ সালের বঙ্গদেশের মানচিত্র সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য কাজ। এটি রাখা আছে একটি বড় কাঠের বাক্সের ভেতর।
বিদেশি বইয়ের সংখ্যা পাঠাগারের বাঁ দিকের তাকগুলোতে। সেখানে পাওয়া যাবে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের লেখা প্রায় সব উপন্যাস। ন্যুট হামসেন, থমাস হার্ডি বা প্যাট্রিক হ্যামিলটনের বইয়ের প্রায় শত বছর আগে প্রকাশিত কপিগুলো আছে, তবে সবই প্রায় নষ্ট হওয়ার পথে। ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’ বইগুলো বাঁধাই করেছিল কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। স্যার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টনের অনুবাদে প্রকাশিত ‘দ্য অ্যারাবিয়ান নাইটস’–এর ১২ খণ্ড অক্ষত আছে এখনো। পাঠযোগ্য অবস্থায় আছে দুর্গাদাস লাহিড়ীর ‘পৃথিবীর ইতিহাসের কয়েক খণ্ড’, দীনেশচন্দ্র সেনের ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ অথবা রজনীকান্ত গুপ্তের ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’।
তবে তালিকা না থাকায় কর্তৃপক্ষও এখন আর নির্ধারণ করতে পারছেন না নষ্ট বা হারানো বইয়ের তালিকা। যেমন ‘ভারত ভৈষজ্য তত্ত্ব’ গ্রন্থের কয়েক খণ্ডের পাশের ১০টি বই এখন শুধু বই নামের ফসিল হয়েছে। ভেতরের পৃষ্ঠার দর্শন বহুদূর, নামও উধাও। হাতে নিলে বালুর মতো গুঁড়া ঝরে পড়ে। বাংলা ভাষার আদি গদ্যের মধ্যে একটা বিশেষ বই ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ–ভেদ’। বইটি বিশেষ চিহ্নিত করে শেলফে এর নাম লেবেল লাগানো হয়েছিল। নামটি আছে, তবে বইটি পাঠাগার থেকে উধাও। এ বছরের ১৩ মার্চের হিসাব অনুযায়ী বাংলা একাডেমির পাঠাগারে মোট বইয়ের সংখ্যা এখন ১ লাখ ১৫ হাজার ৭২৩। এ বইগুলো মূল তালিকার অন্তর্ভুক্ত কি না, জানে না কর্তৃপক্ষ।
মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির পাঠাগার প্রসঙ্গে লিখিত তথ্য পাওয়া যায় বশীর আল্হেলালের লেখা ‘বাংলা একাডেমির ইতিহাস’ বইতে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত এ বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় ‘১৯৬১ থেকে ৭১’–এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছার জমিদার জিতেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর কাছ থেকে তাঁদের পারিবারিক গ্রন্থাগারের মূল্যবান সংগ্রহ, সাড়ে ১০ হাজার বই, অল্প মূল্যে, ১৫ হাজার টাকায় ক্রয় করেন। ১৯৭২ সালে এ সংগ্রহ বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারের সঙ্গে যুক্ত হয়।’
যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই এ পাঠাগারের স্মৃতি আছে মো. আবদুর রশীদের। ১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দেখেছিলেন পাঠাগারটি। পরে দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমিতে কাজ করে অবসর নিয়েছেন ২০০৫ সালে। মো. আবদুর রশীদ জানালেন, ‘বইয়ের সংখ্যা জানি না, তবে এই পাঠাগারের বইয়ের একটা তালিকা ছিল। তালিকা ধরে আমাকে বই দেওয়া হতো। তাকে গুছিয়ে রেখেছি। তখন এটা ছিল বাংলা একাডেমির মূল ভবনে। তবে ১৯৭০ সালে কাজ শুরুর পর আমি কখনো সাধারণ পাঠকদের এই পাঠাগার ব্যবহার করতে দেখিনি। বিশেষ কেউ এলে ঘুরে দেখত ।’ কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, পাঠাগার তালাবদ্ধ থাকে না। তবে একাধিক কর্মদিবসে গিয়ে পাঠাগারটি দেখতে হয়েছে চাবি আনিয়ে তালা খুলে।
গ্রন্থাগার উপবিভাগের পাণ্ডুলিপি সম্পাদক বৈশাখী রাণী বলেন, ‘বইগুলো নিয়ে নতুন করে তালিকা তৈরির পাশাপাশি বই সম্পর্কে কিছু তথ্য লেখার কাজ শুরু হয়েছিল। তবে এ কাজ দু–একজন করে শেষ করতে পারবে না। এই ধুলার ভেতর বেশিক্ষণ থাকাও যায় না। এখন প্রকল্পের জন্য আটকে আছে।’
বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার বিভাগের পরিচালক (চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘এই পাঠাগারের কিছু বই নষ্ট হয়েছে উইপোকা বা বিভিন্ন কারণে। সে সংখ্যা খুব সামান্যই। বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার ডিজিটালাইজেশন করার কাজটি প্রকল্প পাসের জন্য আটকে আছে। আমাদের পরিকল্পনায় এর মধ্যে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির পাঠাগারের সংস্কারকাজও আছে। সামনে বঙ্গবন্ধু কর্নার করা হবে। সেখানে আমরা এ পাঠাগার সংযুক্ত করে দেব।’
কিন্তু ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারের অন্তর্ভুক্ত এ পাঠাগারের অস্তিত্ব সম্পর্কেই জানেন না এখানকার কোনো কোনো কর্মকর্তা। দেড় যুগের বেশি সময় ধরে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত দুজন কর্মকর্তার কাছে পাঠাগার সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাঠাগারের অস্তিত্বই জানি না, সেখানকার বইয়ের পরিস্থিত জানা তো পরের কথা। এ নিয়ে আলাপও শুনিনি কখনো কোনো মিটিংয়ে।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়া অপরিচ্ছন্ন অবস্থায়, তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির পাঠাগারের দুষ্প্রাপ্য ১০ হাজার বই। তালিকাহীন এই মূল্যবান বইগুলো একাডেমির কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে ফেরত না দিলে তা–ও জানার কোনো উপায় নেই কর্তৃপক্ষের। এভাবে দ্রুতই এ বইগুলো নষ্ট হচ্ছে, যা আছে তা–ও রক্ষা করা সম্ভব হবে কি না, জানতে চাইলে মো. শাহাদাৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির পাঠাগারের বইগুলোর দুরবস্থা এক দিনে হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরেই একটু একটু করে নষ্ট হচ্ছে। আমরা নিয়মিত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করছি। রোজই খোলা হয়।’