মিয়ানমারের প্রতি আস্থার ঘাটতি প্রত্যাবাসনে বাধা

0
156
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির

রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কক্সবাজার থেকে তাঁদের একটি প্রতিনিধিদলকে গত শুক্রবার মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা রাজ্যটিতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছয় বছর পর আদি নিবাসে ঘুরে এসে তাঁরা মিয়ানমারে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, রাখাইনে ফেরার মতো পরিবেশ নেই। তাঁদের ভিটেমাটি গুঁড়িয়ে দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ব্যারাক, ফাঁড়ি ও চৌকি। মংডুতে আদি নিবাসের পরিবর্তে তাঁদের রাখার জন্য ‘মডেল গ্রাম’ তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের প্রতি তাঁদের আস্থার ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে নিয়ে চীনের এবারের প্রত্যাবাসনের চেষ্টাও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে কি না, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। এর আগে মিয়ানমারের আন্তরিকতা এবং রাখাইনের পরিবেশ নিয়ে রোহিঙ্গাদের আপত্তির কারণে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুই দফা চেষ্টা করেও প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির

বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন অবশ্য গতকাল শনিবার রাজধানীতে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে চীন অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশ এ সমস্যা সমাধানে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশও আশাবাদী। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হলেও প্রত্যাবাসন এবার শুরু হতে পারে।

■ চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়েছিল।

■ এর আগে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের তারিখ চূড়ান্ত করেছিল ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৯ লাখ ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও বর্তমানে তারা একটি বড় আর্থসামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তাও কমে আসছে।

ফিরে যেতে অনাগ্রহ

প্রত্যাবাসন দুই দফা ব্যর্থ হওয়ার পর এবার পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে পাঠানোর কথা রয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মংডুর ১৫টি গ্রামে রোহিঙ্গাদের নেওয়ার কথা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দুটি গ্রামে রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এসব বাড়ি তৈরি হয়েছে চীন, জাপান ও ভারতের অর্থায়নে। ১৫ গ্রামে সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ হাজার রোহিঙ্গার থাকার ব্যবস্থা করা হবে।

শুক্রবার রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা রাখাইন থেকে কক্সবাজারে ফিরে সাংবাদিকদের বলেছেন, মংডুতে তাঁদের জন্য সব গ্রাম এখনো তৈরি হয়নি। সেখানে ফেরার মতো পরিবেশ নেই।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাখাইন সফরের সময় রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরে কী কী সুবিধা পাবেন, তা বলা হয়েছে। এসব সুবিধার মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে একটি বাড়ির পাশাপাশি তিন একর আবাদি জমি, বীজ ও কৃষি উপকরণ দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গারা তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনা করানোর সুবিধা পাবেন। কেউ চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন। এরপরও রোহিঙ্গারা আদি নিবাসের পরিবর্তে ওই সব মডেল গ্রামে যেতে আগ্রহী নন।

ইউএনএইচসিআরকে যুক্ত রাখার চেষ্টা

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, ইউএনএইচসিআর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কাজটি সম্পাদন করবে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এবারের পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ইউএনএইচসিআরকে যুক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা দাতাদের সম্পর্ক ভালো নয়। এমন প্রেক্ষাপটে ইউএনএইচসিআরের মিয়ানমার দপ্তর তাদের কর্মকর্তাদের নেপিডো থেকে রাখাইনে যেতে দিচ্ছে না। তাই প্রত্যাবাসন শুরু হলে তাতে ইউএনএইচসিআরের যুক্ততার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ফলে রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের যে আস্থার ঘাটতি, তা নিরসনে জাতিসংঘের যুক্ত থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রসঙ্গত, গত মার্চে রাখাইনে বাংলাদেশসহ আট দেশের কূটনীতিকেরা সফর করেন। এরপর রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে এসেছিল। সে সময় মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের পরিবহনে স্পিডবোট সরবরাহ করেছিল ইউএনএইচসিআর। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল পশ্চিমা দাতারা। তখন ইউএনএইচসিআর ব্যাংকক থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয়। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের আলোচনায় তারা জড়িত নয়।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমারের নেপিডো সফর করেন চীনের বিশেষ দূত দেং সি জুন। তিনি সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সেনাশাসকের সঙ্গে আলোচনা করেন। চীনের বিশেষ দূত দেং সি জুন গত এপ্রিলে ঢাকায় এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেন। ঢাকা ও নেপিডো আলোচনার ধারাবাহিকতায় গত ১৮ এপ্রিল কুনমিংয়ে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে এ মাসের মাঝামাঝি প্রত্যাবাসন শুরুর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল শুক্রবার রাখাইনে যায়।

জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গতকাল  বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সম্প্রতি কুনমিংয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা শুক্রবার প্রথমবারের মতো রাখাইন ঘুরে দেখলেন। মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদলও বাংলাদেশে আসবে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে আশা করছি। তবে সেটা ঠিক কবে শুরু হবে, সে খবর এখনো পাইনি।’

হঠাৎ মিয়ানমার-চীনের তৎপরতা

চীনের প্রভাবে মিয়ানমার হঠাৎ কেন এ মাসের মাঝামাঝি প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়—এটা বাংলাদেশ বুঝতে চাইছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। বিশেষ করে এমন তৎপরতার পেছনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ২৪ মে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার বিষয়ে মিয়ানমারের সাফাইয়ের দিকটি যুক্ত থাকতে পারে। এর পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক চাপ কমানোসহ চীনের বিশেষ কোনো স্বার্থ আছে কি না, সেটা বোঝাও জরুরি বলে মনে করছে কূটনীতিক মহল। গত সপ্তাহে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং ভারত সফরের আগে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান শোয়ের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তাঁদের আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি এসেছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীর গতকাল  বলেন, রাখাইনের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে মিয়ানমারকে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ফেরাটা যাতে টেকসই হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে প্রয়োজনে জাতিসংঘ, আসিয়ানকেও যুক্ত করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্রত্যাবাসনটা যেন তাড়াহুড়া করে না হয়। কারণ, পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রত্যাবাসন হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল না। এই প্রত্যাবাসন যেন ধারাবাহিক এবং টেকসই হয়, বিষয়টি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.