বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার ৯১১। কিন্তু দেশে মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) গ্রাহক এখন ১৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার ১৭১। এর কারণ, একজন গ্রাহক একাধিক সেবায় হিসাব খুলতে পারেন।
হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোনটি যে আর্থিক লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম হবে, তা এক থেকে দেড় যুগ আগে সম্ভবত কারও কল্পনায় ছিল না। আর এখন হাতে থাকা মোবাইল ফোনটিই হয়ে উঠেছে সব ধরনের লেনদেনের অপরিহার্য মাধ্যম। এসব লেনদেনের হিসাব খুলতে কোথাও যেতে হচ্ছে না। গ্রাহক নিজেই অনায়াসে নিজের হিসাব খুলে লেনদেন করতে পারছেন।
এক মোবাইল ফোনের সাহায্যে অন্যকে টাকা পাঠানো, মোবাইল রিচার্জ, বিভিন্ন পরিষেবা ও কেনাকাটার বিল পরিশোধ, টিকিট কেনাসহ কত সেবা যে মিলছে, তা এক দমে বলা কঠিনই বৈকি। সব মিলিয়ে বিকাশ, রকেট, নগদ ও উপায়ের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে আর্থিক স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে। এসব সেবায় গত জানুয়ারিতে লেনদেন হয়েছে এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার ৯১১। কিন্তু দেশে মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) গ্রাহকের সংখ্যা গত ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে হয়েছে ১৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার ১৭১। এই সংখ্যা জানুয়ারিতে ছিল ১৯ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ১৩৭। কারণ, একজন গ্রাহক একাধিক সেবায় হিসাব খুলতে পারেন। ফলে প্রকৃতপক্ষে ঠিক কত নাগরিক এমএফএসের আওতায় এসেছে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে প্রতিটি পরিবারেই সেবাটি পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে করোনাকালে সরকারি প্রণোদনার টাকা বিতরণের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এমএফএস। এ কারণে অনগ্রসর গোষ্ঠীও এই সেবায় চলে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত জানুয়ারিতে এসব সেবায় লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ৫৯৩ কোটি টাকা, যা ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা কমে হয় ৯৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর আগে ডিসেম্বরে লেনদেন হয়েছিল ৯৬ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। গত বছরের এপ্রিলে এসব সেবায় লেনদেনের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ১ লাখ ৭ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আনুষ্ঠানিক মাধ্যমের কারণে এসব লেনদেনের হিসাব থাকছে। কে কাকে কখন কত টাকা দিচ্ছেন, সেই তথ্য জমা থাকছে, যা প্রয়োজনে পরে জানা যাচ্ছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, এসব সেবা অবৈধ অর্থায়ন কিংবা ঘুষের মতো অপরাধ কমাতে বড় মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
এমএফএস সেবা প্রদানে শীর্ষে রয়েছে বিকাশ। বর্তমানে বিকাশের নিবন্ধিত গ্রাহক ৬ কোটি ৭৫ লাখ। তাঁদের দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ কম–বেশি দুই হাজার কোটি টাকা। অন্য সেবার পাশাপাশি বিকাশ দিয়ে এখন ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব খুলে টাকা জমা দেওয়া ও ছোট অঙ্কের ঋণ সুবিধা নেওয়া যায়, যা বিকাশকে এগিয়ে রেখেছে।
বিকাশের করপোরেট কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে মোবাইলে লেনদেনের অভ্যস্ততা তৈরি হচ্ছে। আস্থাও বাড়ছে। কার্যকর ইকোসিস্টেম তৈরির মাধ্যমে মোবাইল লেনদেনের পরিসর আরও বেশি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে বিকাশ। তিনি আরও বলেন, মোবাইলে আর্থিক সেবায় একটা সময় পর্যন্ত কেবল টাকা পাঠানো, উত্তোলন বা মোবাইল রিচার্জের মতো কার্যক্রম চালু ছিল। এখন ন্যানো লোন (ক্ষুদ্র ঋণ), মাসিক সঞ্চয় সেবা, পরিষেবার বিল পরিশোধ, সব ধরনের টিকিট কেনা, অনলাইন-অফলাইনসহ সব ধরনের লেনদেন মুহূর্তেই করার সুযোগ দিচ্ছে বিকাশ, যা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে।
মাসে লাখ কোটি টাকার লেনদেন
গত জানুয়ারিতে এমএফএস সেবায় সব মিলিয়ে গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ১৩৭। তবে সক্রিয় গ্রাহক ৬ কোটির কম। ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক বেড়ে হয়েছে ১৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার ১৭১। একজন ব্যক্তি একাধিক সেবা ব্যবহার করতে পারেন বলে প্রকৃত হিসাবধারী ঠিক কত জন, তা জানা যায়নি। গ্রাহকদের সেবা দিতে সারা দেশে এজেন্ট রয়েছে ১৫ লাখ ৬৯ হাজার ১১২। অবশ্য একটি এজেন্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের সেবা দিতে পারে।
গত জানুয়ারিতে ১ লাখ ৫৯৩ কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে টাকা জমা ও উত্তোলন হয়েছে যথাক্রমে ৩১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ও ২৮ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। গ্রাহক থেকে গ্রাহকের কাছে পাঠানো হয়েছে ২৮ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা।
কেনাকাটায় খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা, সরকারি ভাতা দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা, বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া মোবাইল রিচার্জ করা হয়েছে ৯০৫ কোটি টাকা ও পরিষেবা বিল দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা।
গ্রাহকদের শুধু টাকা উত্তোলনের জন্য বাড়তি মাশুল গুনতে হয়। ফলে যে লেনদেন হয়েছে, তার ২৮ শতাংশের জন্য ব্যবহারকারীকে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়েছে। আরও ২৯ শতাংশ অর্থ একে অপরকে পাঠাতে অল্প কিছু খরচ গুনতে হয়েছে।
এমএফএস সেবায় এখন দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নগদ। নগদের মাধ্যমে দৈনিক লেনদেন হাজারকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত কোটি ছিল বলে জানান এর যোগাযোগ বিভাগের প্রধান জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইদানীং গ্রাহকদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সহজে ও কম খরচে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আনার সেবা চালু হয়েছে। ফলে সেবার আওতা বেড়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন সরকারি ভাতা, উপবৃত্তি ও আর্থিক সহায়তার সিংহভাগ নগদই বিতরণ করে।
সেবাটির উপকারভোগী সবাই
এই সেবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ রেখে চালু হলেও এখন শহরে বসবাসকারী নাগরিকেরাও এর বড় ব্যবহারকারী। ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি এই সেবা এখন শুধু টাকা পাঠানো ও গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিভিন্ন পরিষেবা ও কেনাকাটার বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টাকা জমানো, ঋণ গ্রহণসহ নানা ধরনের লেনদেন করা যাচ্ছে। বিশেষ করে উৎসব-পার্বণে এমএফএস সেবার ব্যবহার বেড়ে যায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
এদিকে এমএফএস চালুর ফলে শুধু কম আয়ের মানুষের সুবিধা হয়েছে, বিষয়টি তেমন নয়। বড় করপোরেট ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পমালিকেরাও এর সুবিধা পেয়েছেন। এখন দেশের প্রায় সব বড় ভোগ্যপণ্য প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রির টাকা এ সেবার মাধ্যমে সংগ্রহ করছে, যাকে কালেকশন সেবা বলছে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক বড় শিল্প গ্রুপ তাদের শ্রমিকদের বেতনও দিচ্ছে এমএফএসের মাধ্যমে। এ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ ও আদায় এবং বিদেশি সংস্থার তহবিল বিতরণও হচ্ছে এই সেবার মাধ্যমে।
বর্তমানে দেশে ডাক বিভাগের সেবা নগদসহ বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত এমএফএস প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৩টি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়, এমক্যাশ, মাইক্যাশ, ট্যাপ। দেশে মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চে। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম দেওয়া হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে বিকাশ।
বিগত কয়েক বছরে অনেক প্রতিষ্ঠান এ সেবায় যুক্ত হলেও এখনো সেবা মাশুল অনেক বেশি বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। বর্তমানে ১ হাজার টাকা তুলতে একজন গ্রাহককে খরচ করতে হয় সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ টাকা। যদিও অনেকে নানা অফার দিয়ে ও একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত কম খরচে উত্তোলন সুবিধাও দিচ্ছে। কম খরচে টাকা উত্তোলনের সুবিধা চালু করে নগদ। এরপর অন্যরাও এ পথে পা বাড়ায়।