বাতাসে গ্যাসের গন্ধ

0
199

সোমবার ২৪ এপ্রিল। ঈদের ছুটি শেষে প্রথম কর্মদিবস। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আকস্মিক খবর এলো– রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় বাতাসে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। গন্ধের মাত্রা ভয়াবহ। চারদিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত। কোনো কোনো এলাকার মসজিদ থেকে মাইকিংও করা হচ্ছে। এ খবর সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে টিভি চ্যানেলে। শঙ্কিত মানুষের ফোনকলের চাপ বাড়ছে পুলিশের ট্রিপল নাইন নম্বরে। পুলিশ সদস্যরাও ঘটনাস্থলে গিয়ে গ্যাসের বিকট গন্ধ পাচ্ছেন। ফায়ার সার্ভিসের লোকও বেরিয়ে পড়েছেন। খবর শুনে কিছুটা অবাক হলাম। দীর্ঘকাল গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে লেখালেখি করি। সংগত কারণে এ-বিষয়ক খবরের প্রতি আগ্রহ একটু বেশি।

এমনিতে ঢাকায় এখন আগুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ, গরমকালে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটে। সম্প্রতি বঙ্গবাজারসহ বেশ কয়েকটি ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কয়েকটি ভবনে আগুনের কারণ হিসেবে গ্যাস লিকেজকে দায়ী করা হচ্ছে। ফলে এই গ্যাস নিয়ে ভীতি আছে নগরবাসীর মনে।

তবে গ্যাস লিকেজ নতুন কোনো খবর নয়। গ্যাস ব্যবহারকারীরা ভালোভাবে শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। রাজধানীসহ আশপাশ এলাকায় হাজার কিলোমিটার গ্যাস সরবরাহ ও সঞ্চালন লাইন আছে। এই লাইন ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ বছরের পুরোনো। মাটির নিচে এই পাইপে অসংখ্য ছিদ্র, যে ছিদ্র দিয়ে মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও গ্যাস বের হয়। গন্ধ পেয়ে কেউ অভিযোগ করলে সরকারি সংস্থা তিতাসের লোকজন গিয়ে সেটি মেরামত করে দেন। এটি খুবই সাধারণ ঘটনা।

কিন্তু সোমবার রাতে যেটি ঘটেছে, সেটি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। এটি অস্বাভাবিক। কারণ, এ রকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না। তিতাসের ইমার্জেন্সি টিম এটি দ্রুত সমাধান করেছে। দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বড় বিপদ হতে পারত। কিন্তু কী এমন ঘটনা ঘটল? যে কারণে একই সময়ে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় মাটির নিচে বসানো পাইপলাইনের শত শত ছিদ্র দিয়ে একই সঙ্গে মাটি ভেদ করে গ্যাস বেরুতে থাকল। চারদিক বিকট গন্ধে নগরবাসী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল।

মঙ্গলবার খবরে বলা হয়, সোমবার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা, বাড্ডা, রামপুরা, মহাখালী, মগবাজার, দিলু রোড, ইস্কাটন, হাজারীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্ক দেখা দেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ বিষয়ে থানা, ফায়ার সার্ভিসসহ জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ ফোন আসা শুরু হয়। এ সময় বিভিন্ন এলাকার মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে গ্যাসের চুলা এবং দেশলাই না জ্বালাতে অনুরোধ জানানো হয়। আতঙ্কে অনেকে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। অনেকে ফেসবুকে পোস্ট করেও বিষয়টি জানান। তবে কোথাও কোনো বড় দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে রাতেই এক বিবৃতিতে তিতাস গ্যাস জানায়, ঈদের ছুটিতে সব শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় ঢাকায় গ্যাসের প্রেশার বা চাপ বেড়েছে (ওভার ফ্লো)। আবার ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় গ্যাসলাইনে ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে। সাধারণ সময়ে গ্যাসের চাপ কম থাকায় ওই লিকেজ দিয়ে গ্যাস বের হয় না। এখন হয়তো ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে থাকতে পারে। গ্যাস লিকেজ চেক করার জন্য অডোরেন্ট ব্যবহার হয়। অডোরেন্ট ব্যবহারের জন্য গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আগে গ্যাসে অডোরেন্ট ব্যবহার করা হতো না।

মঙ্গলবার দুপুরে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। এ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সোমবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঢাকার রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী, বেইলি রোডসহ কয়েকটি এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক তিতাস গ্যাসের ১৪টি ইমার্জেন্সি টিম ওইসব এলাকা পরিদর্শন করে এবং জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়। একই সঙ্গে যেসব ডিস্ট্রিক্ট রেগুলেশন স্টেশন-ডিআরএসের মাধ্যমে ঢাকায় গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে, সেগুলো থেকে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দেওয়া হলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, ঈদুল ফিতরের ছুটিতে শিল্পকারখানা বন্ধ থাকাসহ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গ্যাসের ব্যবহার কমে যাওয়ায় গ্যাস সরবরাহ লাইনে চাপ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তবে বর্তমানে গ্যাসের সরবরাহ লাইনে চাপ স্বাভাবিক রয়েছে এবং গ্যাসের সরবরাহ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জনসাধারণকে আতঙ্কিত না হয়ে নির্বিঘ্নে গ্যাস ও গ্যাসের চুলা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।

পরিতাপের বিষয়– জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, জিটিসিএল (গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ) কিংবা তিতাস গ্যাস– কেউই সম্ভাব্য বিপদের কারণটি বলল না। এ বিষয়ে যাঁরা সামান্যতম খবর রাখেন তাঁরা জানেন, ঈদের ছুটির সময়ে গ্যাস-বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। এ সময়ে মিল-কারখানা বন্ধ থাকে। আমরাও জানি, গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক সিস্টেম আছে। এ সমন্বয় সাধন প্রক্রিয়া দেখভাল করার জন্য দায়িত্বশীল প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা আছেন। তাঁরা সোমবার রাতে কোথায় ছিলেন? তাঁরা যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাহলে কাদের গাফিলতি বা অবহেলায় সরবরাহ লাইনে গ্যাসের প্রবাহ বা চাপ অনাবশ্যক বেড়ে গেল? স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে ছিদ্র দিয়ে অতিমাত্রায় গ্যাস বের হবার কথা নয়। অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টির কারণেই ছিদ্র দিয়ে ব্যাপকভাবে গ্যাস বের হতে থাকে। গন্ধ চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এটি স্বীকার করতে হবে যে, চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা টের পেলাম– আমাদের পাইপলাইনে কী পরিমাণ ছিদ্র আছে এবং কতটা দুর্বল।

তবে এটিও সত্য, পাইপলাইনে অসংখ্য ছিদ্র থাকার কারণেই আমরা অনেক বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। এই অতিরিক্ত প্রবাহের গ্যাস বের হতে না পারলে যে কোনো জায়গায় পাইপলাইনে বিস্ফোরণ হতে পারত। গ্যাস বিস্ফোরণ হলে তার পরিণতি কী ভয়ংকর, তা অনেকেই জানেন। কতিপয় কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে অনেক বড় বিপদ ঘটতে যাচ্ছিল। তিতাস বলছে, তাদের ইমার্জেন্সি টিম দ্রুত গ্যাসের চাপ কমিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। কিন্তু গ্যাসের চাপ অতিমাত্রায় বাড়ল কেন? গ্যাস সঞ্চালন ও সরবরাহের দায়িত্বে কারা ছিলেন? সেখানে কি কারও কোনো গাফিলতি ছিল? এটি তদন্ত করে দেখা উচিত। কারও কোনো অবহেলা থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

পেট্রোবাংলার দু’একজন কর্মকর্তা বলার চেষ্টা করছেন, কেমিক্যাল ও গ্যাসের চাপ বাড়ার যৌক্তিক কারণ ছিল। গ্যাস পাইপলাইনে সাধারণত স্বল্প চাপই থাকে। যে কারণে বাসাবাড়ি বা কলকারখানা প্রকৃত চাপে গ্যাস পায় না। এ জন্য পরীক্ষামূলক এই চাপ বাড়ানো হয়। এতে গ্যাসের লিকেজগুলো শনাক্ত করাও সহজ হয়। আমার বক্তব্য হলো– এ ধরনের পরীক্ষা চালানো যেতেই পারে। কিন্তু আমরা জানি, এ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা কোথাও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হলে আগে থেকেই গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা গ্রাহকদের জানানো হয়। প্রয়োজনে মাইকিং করা হয়। এবার এ রকম কিছু করা হয়নি। ফলে রাতে নগরবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ সবাইকে ধকল পোহাতে হয়। এটি কতটুকু যৌক্তিক?

সবুজ ইউনুস: সহযোগী সম্পাদক, সমকাল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.