রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ নিয়ে সংশয়

0
190
আইএমএফ

আইএমএফের দলটি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করে দেখবে তাদের দেওয়া শর্ত পূরণে আগামী বাজেটে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রার এখনকার মজুত বা রিজার্ভ এবং আগামী জুনের সম্ভাব্য পরিমাণ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির ঢাকা সফরকারী স্টাফ কনসালটেশন মিশন গতকাল মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছে, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা। কিন্তু সে লক্ষণ তারা দেখতে পাচ্ছে না। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আইএমএফের এ মিশন ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবে বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর পক্ষে। এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের মনোভাব তারা বুঝতে চেয়েছে। তবে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সরাসরি কিছু জানানো হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনসহ অন্য ডেপুটি গভর্নর ও অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবদের সঙ্গে গতকাল দিনব্যাপী বৈঠক করে আইএমএফের এ মিশন। গতকাল শুরু হওয়া এ মিশন আগামী ২ মে পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করবে।

প্রথম দিন গতকাল আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান ও মিশন চিফ উপস্থিত ছিলেন না। ছিলেন আইএমএফের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান (আবাসিক প্রতিনিধি) জয়েন্দু দেসহ সফরকারী মিশনের অন্য ছয় সদস্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেটি শেষ করে তিনি ঢাকায় আসবেন বলে সূত্রগুলো জানায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী ১৮ এপ্রিল রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১১৮ কোটি ডলার। আইএমএফ অবশ্য এ পদ্ধতি মানে না। কারণ, রিজার্ভের অর্থে বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ; রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন; বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংককে ধার; পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতে অর্থ দেওয়া এবং শ্রীলঙ্কাকে অর্থ ধার দেওয়া বাবদ খরচ ৮২০ কোটি ডলার রয়েছে। আইএমএফের মতে, এগুলো বাদ দিলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ২ হাজার ৩০৮ কোটি ডলার।

আইএমএফ যে গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, অন্য অনেক শর্তের মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে জুনের মধ্যে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ অন্তত ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারে উন্নীত করা। জুন এখনো শেষ হয়নি। সে হিসাবে ঘাটতি আছে ১৩৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১৭ কোটি ডলারের একটি পাওনা পরিশোধ করতে হবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে। তখন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়াবে ১৫৩ কোটি ডলার। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করতে হবে বলে ঘাটতি আরও বাড়বে বলে বৈঠকে প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ।

জানা গেছে, আইএমএফ মিশনের সদস্যরা শুধু জুনের মধ্যে রিজার্ভের শর্ত পূরণ না হওয়া নয়, আগামী সেপ্টেম্বর এমনকি ডিসেম্বরের জন্যও একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গতকাল। কারণ, তখন রিজার্ভ আরও বাড়িয়ে রাখতে হবে। যেমন আইএমএফের মানদণ্ড অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২ হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারের নিচে থাকতে পারবে না।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাকি আছে আর ২ মাস ৪ দিন। এ সময়ের মধ্যে রিজার্ভকে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নিয়ে যেতে সরকারের কৌশলও গতকাল জানতে চেয়েছে আইএমএফের দল। দলটিকে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং বিশ্বব্যাংক থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। এগুলো দিয়ে ঘাটতি অর্থ পূরণ করা সম্ভব হবে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তা পাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত হতে পারেনি আইএমএফের দল।

গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখন এপ্রিল চলছে। আরও সময় আছে। এ মুহূর্তে এ বিষয়ে (রিজার্ভ) কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। তবে আশা করছি জুন শেষে রিজার্ভ আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, আগামী জুলাই থেকে রিজার্ভের গণনা এমনভাবে করা হবে, যাতে মোট রিজার্ভের পাশাপাশি প্রকৃত (নিট) রিজার্ভের হিসাবও থাকবে।

বিদ্যুতের দাম কি আরও বাড়বে

ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সঙ্গে দেওয়া শর্তের মধ্যে গত জানুয়ারিতে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার উন্নতির কথাও বলেছিল আইএমএফ। ভর্তুকি কমাতে আইএমএফের ঋণ অনুমোদনের আগেই সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে সারের দামও। তার পরও আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ এক লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা করেছে অর্থ বিভাগ।

সূত্রগুলো জানায়, জ্বালানি তেলের দাম এখন আন্তর্জাতিক বাজার দরের কাছাকাছি। ফলে গতকালের বৈঠকে আইএমএফের দল বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো যায় কি না, অর্থ বিভাগের কাছে সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে তা নিয়ে মিশনটিকে স্পষ্ট কিছু জানানো হয়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে, জ্বালানি তেলের মূল্য আগামী সেপ্টেম্বর থেকেই তিন মাস পরপর আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিট ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে।

রাজস্ব-জিডিপির হারের উন্নতি কীভাবে

এবারের মিশনের প্রথম দিনের বৈঠকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আয় অর্থাৎ রাজস্ব-জিডিপির হার বৃদ্ধি নিয়ে আইএমএফের দলটির প্রশ্ন বেশি ছিল বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। কর আদায়ে রাজস্ব খাতে সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি জানতে চাওয়া হয়েছে আইএমএফের পক্ষ থেকে। তবে প্রাথমিকভাবে গতকাল এ নিয়ে আলোচনা হলেও মূল আলোচনা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গেই করা হবে বলে সূত্রগুলো জানায়।

গতকালের বৈঠকে আইএমএফকে জানানো হয়েছে, কর আদায়ে ইলেকট্রনিক ফিশক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) কেনা হয়েছে, আরও কেনার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের চাওয়া বেশি নয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য আইএমএফ চায় রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি। এ বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা মিশনটির কাছ তুলে ধরবে এনবিআর।

অন্যান্য প্রসঙ্গ

আগামী জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে যে শর্ত পূরণ হওয়ার কথা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে যেসব শর্ত পূরণ হওয়ার কথা, তার সবই সপ্তাহব্যাপী আলোচনায় উঠে আসবে বলে জানা গেছে। এসব শর্ত পূরণে বাজেটে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, অর্থ বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনায় তা গতকালও কিছুটা উঠে আসে। এ ছাড়া আলোচনা হয়েছে ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা ও বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করা ইত্যাদি বিষয়ে।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আইএমএফের এবারের মিশনের চাওয়াগুলো নিয়ে বলেন, ‘ধরে নিচ্ছি আগামী দুই মাসে কিছু ডলার আসবে। তবে রিজার্ভটা আইএমএফের জুনের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখতে সরকারের উচিত হবে ডলার বিক্রি একদম বন্ধ করে দেওয়া। যে ঘাটতিটা দেখা যাচ্ছে, তা কম নয় এবং রিজার্ভে আইএমএফের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারাটা বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না।

লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে ‘দুর্বল পারফরমার’ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়বে বলেও মনে করেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম নিয়ে সরকার একটা মূল্যায়ন করতে পারে এবং বাড়াতে হলে তা এখনই দরকার। পরে নির্বাচন চলে আসবে।

রাজস্ব-জিডিপির হার বৃদ্ধির বিষয়ে আগামী বাজেটে স্পষ্ট ঘোষণার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা প্রণয়ন করা দরকার বলেও মনে করেন আহসান এইচ মনসুর।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.