১৯৮৮ সালের কোনো একদিন। দেশজুড়ে তখন বন্যা। হাতে কাজ নেই। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তখন ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার অদম্য চেষ্টা মানুষের ঘরে ঘরে। এরই মধ্যে একদিন স্বামী আজহার আলী বাজার থেকে ফিরে একটা সুতার টুপি আর কুরুজ-কাঁটা ধরিয়ে দিলেন ওয়াজেদা বেগমের হাতে। বললেন টুপি তৈরির চেষ্টা করতে। বছর দু-এক নিজেই বাড়িতে টুপি তৈরি করলেন। পরে সুই-সুতায় টুপি বুননের কাজটা শেখানোর কাজও শুরু করলেন অন্য নারীদের নিয়ে। একসময় গ্রামজুড়ে শুরু হয়ে গেল জালি টুপি তৈরির কর্মযজ্ঞ। এ কাজ করে নিজেরা তো দারিদ্র্য জয় করলেনই, সচ্ছল-স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের চকধলি ও চককল্যাণী গ্রামের আরও অনেক নারীকে।
বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম চককল্যাণী ও চকধলি থেকে টুপি তৈরির কর্মজজ্ঞ এখন ছড়িয়ে পড়েছে শেরপুর ছাড়াও ধুনট, শাজাহানপুর, বগুড়া সদর, শিবগঞ্জ, শাজাহানপুর উপজেলার গ্রামে গ্রামে। এসব টুপি রপ্তানি হচ্ছে ভারত, সৌদি আরব, কাতার, দুবাইসহ বিশ্বের নানা দেশে। টুপিশিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এখানে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত কারখানা, টুপির উপযোগী সুতা তৈরি এবং ধোলাই কারখানা। রপ্তানিও হচ্ছে বিদেশের বাজারে। দেশীয় বাজারে টুপি যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাইকারি বাজারে। সারা বছরই টুপি তৈরির কাজ হয়, তবে মূল বাজার দুই ঈদের সময়ে।
ওয়াজেদা বেগম এখন ৫৪ পেরিয়ে। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই সুই-সুতার কাজে তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল। সেই ঝোঁক আর স্বামীর উৎসাহেই এ পেশায় আসা। তবে যখন কাজটা শুরু করেছিলেন, তখন ভাবেননি, সুই-সুতার ফোঁড়ই ঘরে ঘরে নারীর উপার্জনের ভরসা হয়ে উঠবে।
দিন–রাত কর্মমুখর টুপিপল্লি
সরেজমিনে বগুড়ার শেরপুর ও ধুনট উপজেলার টুপিপল্লি ঘুরে কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই দুই উপজেলায় ৬০ থেকে ৭০টি গ্রাম এখন রীতিমতো টুপিপল্লি হিসেবে গড়ে উঠেছে।
ঘরে ঘরে নারীরা দিন–রাত ব্যস্ত সুই-সুতা হাতে টুপি তৈরির কাজে। যেমনটা শেরপুর উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের সাতড়া গ্রামের রাহেলা বেগম (৩৫), মাজেদা বেগম (৩৯), জাহেদা বেগম। সাতসকালে যখন তাঁদের বসতবাড়ির উঠানে আমরা পা রাখলাম, ততক্ষণে তাঁদের ভূমিহীন দিনমজুর স্বামীরা অন্যের বাড়িতে কাজ করতে চলে গেছেন। রাহেলা বেগম বলেন, তাঁর বাবার বাড়ি পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায়। স্বামীর সংসারে আসার পর অভাব তাড়াতে টুপি তৈরির পেশা বেছে নেন। সেই শুরু। এ কাজ করে প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ হাজার টাকার বেশি উপার্জন করেন। টুপি তৈরির আয়ে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চলে। বাড়তি টাকা সংসারের খরচের জন্য স্বামীর হাতে তুলে দেন।
মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না মাজেদার, টুপি তৈরির আয়ে এক খণ্ড জমি কিনে বসতঘর গড়েছেন, এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আরও দুই মেয়েকে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করাচ্ছেন। জাহেদা বেগম বলেন, দিনে-রাতে একজন কারিগর ১০ থেকে ১২টি পর্যন্ত টুপি তৈরি করতে পারেন। মাথাপিছু গড়ে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় নারীদের।
একই গ্রামের হিমা খাতুন পড়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। বাবা আবদুল হান্নান সবজি বিক্রেতা। মা জেসমিন বেগমের সঙ্গে বাড়িতে বসে সে–ও টুপি তৈরি করছিল। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি টুপি তৈরি করে বাড়তি আয় করে তারা।
টুপির বাহারি নাম
মাকড়শার জাল, বাটি ফুল, স্টার ফুল, বাদামি ফুল, ভি ফুল, বিস্কুট ফুল, কালারফুল, বকুলফুল, তালা–চাবি। আনারস ও মৌচাক টুপি তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
টুপির বাজার
বগুড়ার বাংলাদেশ জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, প্রতিটি টুপির বাজারমূল্য গড়ে ৩০ টাকা। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ৬০ লাখ টাকার টুপি তৈরি হয়। বছরে টুপি তৈরি হয় ২১৯ কোটি টাকার। এর এক-তৃতীয়াংশ রপ্তানি হয়। বিদেশে রপ্তানি করছেন বগুড়ার ১০ থেকে ১২ জন রপ্তানিকারক।
জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জুয়েল আকন্দ বলেন, ১২ বছর বয়সে মায়ের (ফরিদা বেগম) তৈরি টুপি বিক্রি করতেন তিনি বগুড়া শহরের বড় মসজিদ লেনে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভালো দাম পাওয়ার আশায় কিছু টুপি নিয়ে বিক্রি করতে যান ঢাকার চকবাজারে। পরে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় ব্যবসায় মন দিতে হয়। ২০০২ সালে ৫০০ টাকা পুঁজিতে গ্রামে গ্রামে সাইকেল নিয়ে ঘুরে নারীদের কাছ থেকে টুপি কেনার ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
জালি টুপি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও রপ্তানিকারক কামাল পাশা বলেন, বর্তমানে বগুড়া থেকে বছরে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার জালি টুপি রপ্তানি হচ্ছে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকেও যে বড় উদ্যোগ হতে পারে, বগুড়ার গ্রামে গ্রামে নারীদের টুপি বুনন তারই প্রমাণ। আর ঈদকে ঘিরেই সেই টুপি কারিগরদের মূল কাজের সময়।