নুরুন নাহারের বিয়ে হয় মাত্র ১৪ বছর বয়সে। তাঁর উচ্চতা কম বলে স্বামী পছন্দ করতেন না। এক ছেলে ও দুই মেয়ের জন্মের পর স্বামী বেশ লম্বা এক নারীকে বিয়ে করার পর থেকে আর ভরণপোষণ দেননি। পোশাকশিল্পের কারখানায় শার্টের কলারের বক্রম লাগানোর কাজ করে নুরুন নাহার পেতেন মাত্র ১ হাজার ১৭৫ টাকা। ওই টাকা দিয়েই ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে এখন বেতন পান প্রায় ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকায় ছেলে নিজের সংসার দেখবে না মাকে দেখবে—এ প্রশ্ন সামনে আসার পর থেকেই জটিলতার শুরু।
সমস্যার সমাধানে সত্তরের কাছাকাছি বয়সী নুরুন নাহারের জায়গা হয়েছে শৈলান প্রবীণ নিবাসে। ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ের শৈলান গ্রামে নিবাসের গেটে লেখা, ‘অন্যের জন্য কিছু করি’।
বেশ বড় একটি ঘরে নুরুন নাহারের সঙ্গী এখন তাঁরই মতো আরও তিন প্রবীণ নারী। গোলাপি চাদর বিছানো ছোট একটি বিছানা, কাপড় রাখার জন্য আলনার এক পাশ আর চার তাকের আলমারির একটি তাক নিয়েই এখন নুরুন নাহারের সংসার। ধর্মীয় বই, তসবিহ, টুকটাক কাপড় সেলাইয়ের জন্য সুই–সুতা—সংসারের বিভিন্ন জিনিস বিছানার আশপাশেই গুছিয়ে রাখেন।
নুরুন নাহার নাতির ঘরে পুতির মুখও দেখেছেন। তিন মাস আগে ছেলে নিজেই মাকে এ নিবাসে রেখে গেছেন। এরপর ছেলে আসার আর সময় পাননি। তবে নুরুন নাহার কিছুতেই ছেলেকে নিয়ে মন্দ কিছু বলবেন না। বললেন, এখানে আসতে হলে তো টাকা লাগবে, তাই ছেলে আসতে পারছে না। নুরুন নাহার নিত্য অশান্তির হাত থেকে বাঁচতে নিজেই ছেলেকে বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার বউ–বাচ্চা নিয়ে ভালো থাকো। আমাকে কোনো নিবাসে রেখে আসো।’
নুরুন নাহারের ভরসার জায়গা ছিলেন তাঁর বড় মেয়ে। নানান অসুখে ছয় মাস আগে এই মেয়ে মারা গেছেন। ঈদের পর ছেলে নুরুন নাহারকে দেখতে আসতে চেয়েছেন। শাড়ি পরেন না, তাই শৈলান প্রবীণ নিবাস থেকে ঈদের জন্য ঘরে পরার লম্বা পোশাক ম্যাক্সি, ওড়না আর পাজামা উপহার পেয়েছেন। ম্যাক্সির লম্বাটা কমিয়ে তা সুই–সুতা দিয়ে সেলাই করার কাজে মন দিলেন নুরুন নাহার।
নিবাসে কেমন আছেন, তা জানতে চাইলে নুরুন নাহার বলেন, ‘এখানেই নামাজ পড়ি, ঘুমাই, খাই। নিজের সন্তান রাইখ্যা অন্য জায়গায় থাকতে মন চায় না। কিন্তু এইখানে ছেলে, ছেলের বউ আমারে বোঝা মনে করল কি না, এ চিন্তা তো করতে হয় না। নিজের খরচের কথাও চিন্তা করতে হয় না। শান্তিতে আছি এইখানে।’
গত বুধবার সকালে শৈলান প্রবীণ নিবাসের ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল গাছের ছায়ায় বসে ৭০ বছর বয়সী মো. আলী আনোয়ার মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন। আনোয়ারের স্ত্রী মারা গেছেন প্রায় ১০ বছর আগে। দুই ছেলে, ছেলেদের বউ আর পাঁচ নাতি–নাতনি নিয়েই ছিল তাঁর সংসার। এর আগে দুটি প্রবীণ নিবাস ঘুরে এখন থিতু হয়েছেন শৈলান গ্রামের এ নিবাসে।
আলী আনোয়ার বলেন, ‘বেটার (ছেলে) বউয়েরা আমাকে মেনে নিতে চায়নি। ছেলেদের সংসারে আমার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। নাতিদের নিয়ে আমোদ করতেও অনুমতি লাগত। কিন্তু আমারও তো শখ আছে। এই নিবাসে মন চাইলে গাছে পানি দিই। পত্রিকা পড়ি। ধর্মকর্ম করি। অবসরজীবনে এমন শান্তির পরিবেশই চাইছিলাম।’
ঈদের জন্য এক ছেলে পাঞ্জাবি পাঠিয়েছেন, ছোট বাচ্চাদের মতো বেশ খুশি হয়েই সে পাঞ্জাবি দেখালেন আলী আনোয়ার। নিবাস থেকেও ঈদের উপহার হিসেবে পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, গেঞ্জি পেয়েছেন। দুপুর নাগাদ নিবাস থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আলী আনোয়ারকে দেখা গেল গোসল করে নিবাস থেকে পাওয়া কারুকাজ করা পাঞ্জাবিটি গায়ে দিয়ে বসে আছেন। ঈদের পাঞ্জাবি আগেই পরে ফেললেন কেন জানতে চাইলে একগাল হাসি দিলেন।
নুরুন নাহার, আলী আনোয়ারদের মতো প্রবীণদের কথা চিন্তা করেই ২০২২ সালের ২৬ মার্চ মনোয়ারা ইসলাম-তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের অধীন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় যাত্রা শুরু করেছিল নিবাসটি। গ্রামের একটি খালের পাশে চারতলা ছিমছাম ভবন। ২০টি কক্ষে চারজন করে মোট ৮০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। তবে বর্তমানে আছেন ২০ জন প্রবীণ নারী ও পুরুষ।
নিবাসটিতে গিয়ে দেখা গেল, চারপাশে সবুজ গাছপালা। পাখি সারাক্ষণ কিচিরমিচির করছে। প্রবীণদের হাঁটার জন্যই বানানো হয়েছে একটি হাঁটাপথ। বিভিন্ন গাছপালায় পানি দেওয়াসহ অন্যান্য পরিচর্যা করেন প্রবীণেরা। এবার এই ভবনে লিফট লাগানোর প্রক্রিয়া চলছে। বাথরুমে গিজারসহ প্রবীণদের ব্যবহারের উপযোগী কমোড লাগানো। নিজস্ব সোলার প্যানেল সিস্টেমের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য আইপিএসের ব্যবস্থা করা আছে। প্রবীণেরা খেতে পারেন—এমন খাবারকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। প্রবীণ নারীরা মন চাইলে রান্নার জন্য তরকারি কাটা-বাছাসহ বিভিন্ন কাজে হাত লাগান। টেলিভিশন আছে। ক্যারম বোর্ড ও দাবা খেলার ব্যবস্থা আছে। প্রবীণদের নিরাপত্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। ছাদে বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো হয়েছে। ফিজিও থেরাপির ব্যবস্থা এবং আলাদা একটি চিকিৎসাকক্ষ ও ডিসপেনসারি আছে। জটিল কোনো অসুখে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে। একটি আলমারিতে পড়ার জন্য কিছু বই, পুরুষদের নামাজের জন্য একটি আলাদা কক্ষও আছে। বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন উপহার নিয়ে নিবাসে এসে নিবাসীদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। একইভাবে প্রবীণনিবাসীর ছেলেমেয়ে বা আত্মীয় নিবাসে এসে সময় কাটাতে পারেন, ঈদ বা উৎসবে বাবা বা মাকে বাড়িতে নিয়েও রাখতে পারেন।
নিবাসের বাসিন্দা জ্যোৎস্না পাল ও দীনেশ পাল স্বামী–স্ত্রী। জ্যোৎস্না নারীদের সঙ্গে এবং দীনেশ পুরুষদের সঙ্গে আলাদা কক্ষে থাকেন। দীনেশের একসময় মুদিদোকান ছিল। খেত থেকে আলুসহ অন্যান্য ফসলও পেতেন। জমিজমা বেহাত হয়ে গেছে। তিন মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে মারা গেছেন। দুই মেয়ে থাকেন ভারতে। এক ছেলে রাজধানীর রায়েরবাজারে থাকেন। মেয়ের ঘরের এক নাতনির জামাই সবদিক বিবেচনা করে এক মাস আগে হুট করেই দীনেশ-জ্যোৎস্নাকে নিবাসে রেখে গেছেন।
জ্যোৎস্না পালের হাত সারাক্ষণ কাঁপতে থাকে। চোখেও কম দেখেন। দীনেশ কানে শুনতে পান না। দুজনের শরীরের একাধিক অসুখ। দীনেশের একটু পরপর খিদে লাগে। ছেলে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে করে মা–বাবার দেখভালের খরচ জোগাতে পারেন না। নিবাসে জ্যোৎস্না পালের সেভাবে এখনো মন বসেনি। নিবাসের ওয়াই–ফাই সংযোগে ভারতে থাকা মেয়েসহ অন্যদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন।
জ্যোৎস্না পাল বলেন, ‘মন ভালো লাগে না। মেয়েরা বলে, মা, কাইন্দো না। কিন্তু আমার তো খালি কান্দন আহে। নাতি–নাতনিদের দেখবার জন্য মন চায়। এখন তো আমরা নিরুপায়, চলতেও পারি না। দুজন মানুষের পেট যেহেতু আছে, খাওন তো লাগেই। ওষুধপাতিও লাগে। তাই সব মাইন্যা নিছি।’ নিজের ভগবানকে নিরিবিলি একটু আলাদাভাবে ডাকার সুযোগ পেলে হয়তো জ্যোৎস্না পালের মনটা খানিকটা শান্তি পেত বলেই জানালেন।
নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক মুহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান বলেন, নিবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। নিবাসীদের বিভিন্ন চাহিদাও সামনে আসছে। কোনো দম্পতি থাকলে তাঁদের দুজনকে এক কক্ষে দেওয়া যায় কি না, মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মের জন্য আলাদা একটি উপাসনাকক্ষ তৈরির বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে। কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করবে।
পরিবারে ঠাঁই না পাওয়া প্রবীণদের মনে নানান হতাশা। নিবাসে থাকতে গিয়েও অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে কারও কারও ঝগড়া লাগে। অনেকে নিবাসের নিয়ম মানতে চান না। তখন তত্ত্বাবধায়ককেই কাউন্সেলিং করে তাঁদের শান্ত করতে হয়।
শৈলান গ্রামের স্থানীয় এনজিও ‘সমাজ ও জাতি গঠন’ (সজাগ)-এর পরিচালক আবদুল মতিন নিবাসের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য। তিনি জানান, নিবাসী হতে হলে প্রবীণের বয়স ষাটের কাছাকাছি হতে হবে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং চলাচলে সক্ষম হতে হবে। ভিক্ষুক, নেশায় আসক্ত, অপরাধসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এখানে রাখা হয় না। হতদরিদ্র প্রবীণ নিজে অথবা তাঁর পক্ষ থেকে অভিভাবক বা অন্য কেউ কোনো নিবাসীকে এখানে রেখে যেতে পারেন। এখন পর্যন্ত কোনো প্রবীণ নিবাসে মারা যাননি। কেউ মারা গেলে মৃতের অভিভাবক, আত্মীয়স্বজনের ইচ্ছা অনুযায়ী দাফন-কাফন বা সৎকারের ব্যবস্থা করা হবে।
মনোয়ারা ইসলাম-তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের চেয়ারপারসন ও শৈলান প্রবীণ নিবাসের উদ্যোক্তা দিলরুবা কবির। পারিবারিক এক বিঘা জমিতেই গড়ে তুলেছেন নিবাসটি। বললেন, প্রবীণ নিবাসে থাকা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা বা পাছে লোকে কিছু বলে এ কারণে অনেকেই নিবাসে থাকতে চান না। প্রবীণেরা পরিবারে থাকবেন—এটা অবশ্যই কাম্য। তবে এমন অনেক প্রবীণ আছেন, যেকোনো কারণেই হোক তাঁরা পরিবারে থাকতে পারছেন না। তাঁদের জন্যই এ নিবাস। ৮০ জন প্রবীণকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখার জন্য নিবাসটি প্রস্তুত আছে।
নিবাসের জামিরন, আমিনাদের মতো অনেকেরই স্বামী–সন্তান, কেউ নেই। তাঁরাসহ নিবাসের বাসিন্দারা এবার ঈদ কাটাবেন নিবাসেই। কর্তৃপক্ষ সেমাইসহ ভালো খাবারের আয়োজন করবে ঈদের দিন। তবে ছেলেমেয়ে, নাতি–নাতনিদের ছাড়া ঈদ করার যে হাহাকার, তা হয়তো মনের গহিনে থেকেই যাবে। ঈদের দিনেই নুরুন নাহার হয়তো ভাবতে বসবেন, তিনি তো তাঁর শাশুড়ির যত্নআত্তি করতেন, তাহলে তিনি নিজে কেন ছেলের বউয়ের আদর পেলেন না।
আলী আনোয়ার নিবাস থেকে পাওয়া পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে হয়তো জীবনের হিসাব–নিকাশ করতে বসবেন।