সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বেশি দেখানোই যথেষ্ট?

0
190

মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি ভালো নয়। এতে দারিদ্র্যসীমার আশপাশে ঘোরাঘুরি করা অনেকেই নেমে যাবে নিচে। এ অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ধরে রাখার প্রয়াস নিতে হয় বাজেটে। কর্মসংস্থান বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি সামলানোর সঙ্গে দারিদ্র্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও হয়ে থাকে। এ জন্য নতুন বাজেটে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটা বড় বিবেচ্য। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হলো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। একটা সময় পর্যন্ত এগুলো কোনো ঘোষিত কৌশলের আওতায় পরিচালিত হতো না। ক’বছর আগে এ কারণেই জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল গৃহীত হয়। বলা হয়েছে, এখন থেকে আরও সংগঠিতভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন হবে, যাতে দরিদ্রদের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণরাও উপকৃত হয় এবং নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার শক্তি পায়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত এসব কর্মসূচিতে বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হচ্ছে এবং সরকারের ভাষ্য হলো, তাতে এগিয়ে যাওয়া যাচ্ছে ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে।

সম্প্রতি বিবিএস প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপে (২০২২) গত ছ’বছরে দারিদ্র্য পরিস্থিতির বড় উন্নতি লক্ষণীয়। তাতে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বাড়লেও দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য কমেছে। সরকারি এই সংস্থার জরিপ বলছে, দীর্ঘ সময় ধরে করোনায় থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্য পরিস্থিতির বড় অবনতি হয়নি। অবনতির যে শঙ্কা ছিল; গৃহীত নানা পদক্ষেপে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে বলে এখন দাবি করতে পারে সরকার। অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কার্যক্রমও দ্রুত সুফল দিয়েছে বলে দাবি করা যাবে। শ্রমশক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে পরিচালিত সংস্থাটির পৃথক জরিপ অনুযায়ীও বেকারত্ব পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে বরং উন্নতি হয়েছে।

যে কোনো জরিপ নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা, জরিপ পরিচালনার গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বেসরকারি সংস্থার জরিপ নিয়ে সরকারের তরফে প্রশ্ন তোলা হয় প্রায়ই। বিবিএসের জরিপও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়েও এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে পরস্পরবিরোধী মত প্রকাশ পেয়ে থাকে। তবে সরকারি সংস্থা পরিচালিত জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সত্যের কাছাকাছি হওয়া প্রয়োজন। নইলে এর ভিত্তিতে গৃহীত পরিকল্পনা যথাযথ হবে না। পরিকল্পনা যথাযথ হলেও তার বাস্তবায়নে অনেক ঘাটতি থাকে। আর পরিকল্পনা বাস্তবভিত্তিক না হলে তো সমস্যা হয়ে ওঠে গুরুতর। এ অবস্থায় বেসরকারি সংস্থার জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা কাম্য নয়। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত জরিপেও অনেক সময় অসংগতিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। পরিকল্পনা গ্রহণে সরকার তখন বিভ্রান্তিতে পড়ে বৈকি।

কথা হলো, বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী দারিদ্র্য পরিস্থিতির বড় উন্নতি ঘটলেও অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, সরকার আগামী বাজেটে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি বরাদ্দ রাখছে সামাজিক সুরক্ষা খাতে। এটা আগেরবার ছিল ৫ শতাংশের বেশি। চলমান কোনো কোনো কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ ও আওতা বাড়ানো হচ্ছে। উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশকে যেহেতু এখনও সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা যায়নি, তাই এর আওতা বাড়ানোর প্রয়াস থাকতেই পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাতা বাড়ানোও কাম্য। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করতেও এটা বাড়ানো কর্তব্য। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ তো সামান্য। আরও বেশি মানুষকে আওতাধীন করে কিছুটা বেশি ভাতা জোগানো হলে বরাদ্দ বাড়াতে হবে বৈকি। সমগ্র বাজেটের আকার তো আরও বাড়বে।

তবে সরকার স্পষ্টতই অর্থ সংকটে; নিছক কর-রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে প্রাক্কলিত ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে কিছু অজনপ্রিয় সংস্কারেও যেতে হচ্ছে। জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানো এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যাতে আবার জনগণের জীবনযাত্রা কঠিনতর হচ্ছে। সম্প্রতি বাড়ানো হলো রাসায়নিক সারের দাম। তাতে কিছুটা অর্থ সাশ্রয় হবে সরকারের, কিন্তু কৃষিপণ্যের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকবে। এটা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে না। এদিকে সরকারকে কর-রাজস্ব বাড়ানোর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। আগামী বাজেটে কোন কোন ক্ষেত্র থেকে বেশি রাজস্ব আহরণ করা যাবে, সে আলোচনাও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় সামাজিক সুরক্ষা খাতে প্রায় ২০ শতাংশ বরাদ্দ বাড়ানোর পদক্ষেপ একটু যেন অবাক করে।

এ খাতের কিছু কর্মসূচি আদৌ সামাজিক সুরক্ষার অংশ কিনা, সেটি আলোচিত হচ্ছে অনেক দিন ধরে। যেমন, সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণকারীদের পেনশন। এটা তাদের চাকরির শর্ত হলে এ বাবদ সরকারের ব্যয়কে সামাজিক সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা তো যুক্তিযুক্ত নয়। একই কথা সঞ্চয়পত্রের সুদ ব্যয়ের বেলায় প্রযোজ্য। সম্পদশালীরাও তো সঞ্চয়পত্র কিনে থাকে। এসব ব্যয় যুক্ত করে সামাজিক সুরক্ষা খাতকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। এগুলো বাদ দিলে প্রকৃতপক্ষে সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের বরাদ্দ এখনও অনেক কম।

বাস্তবায়নেও সমস্যা রয়ে গেছে। একে তো উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বড় অংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাইরে রয়ে গেছে; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহায়তাও ভুল লোকের কাছে পৌঁছাচ্ছে বলে উঠে এসেছে গবেষণায়। ভুল লোকের কাছে রাষ্ট্রীয় সহায়তা চলে গেলে এর মাধ্যমেও আর্থসামাজিক অসমতা আরও বাড়তে পারে। সুদীর্ঘ সময়েও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন যেভাবে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিয়োজিত, তা প্রশংসনীয় নয়। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অদক্ষতা ভর করে আছে। দরিদ্রদের ‘ডিল’ করা হয় বলে এ খাতে উচ্চ পর্যায়ের দৃষ্টি বোধ হয় কম। এ অবস্থায় শুধু বরাদ্দ ও আওতা না বাড়িয়ে সুরক্ষা কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও দক্ষ করা বেশি জরুরি।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী দারিদ্র্য পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন যদি ঘটেই থাকে, তাহলে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে চলে আসা সমস্যাগুলো ‘অ্যাড্রেস’ করা হলে আরও বেশি সুফল মিলবে। শতাধিক কর্মসূচি চালু না রেখে সেগুলোকে যৌক্তিক করে একটি পৃথক বিভাগের অধীনে এ কার্যক্রম পরিচালিত হলেও বেশি সুফল মিলত। যেমন, দীর্ঘ করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা সামনে এসেছে। এ অবস্থায় বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্ব আরোপ প্রয়োজন। বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে বয়স্ক ভাতা, তেমনি শিশুমৃত্যু উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসায় তাদের কল্যাণের প্রশ্নটিও গভীর এখন। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আকার বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানে তাদের সহায়তা বিশেষভাবে জরুরি। এসব লক্ষ্য অর্জনে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম যেন গভীরতর ভূমিকা রাখতে পারে।

সামাজিক সুরক্ষা জোরদারের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে অন্তত নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষকে রক্ষা করাও উদ্দেশ্য হতে হবে। নইলে সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় আরও বেশি করতে হবে ভবিষ্যতে। কিন্তু কর-রাজস্ব দ্রুত বাড়ানোর সক্ষমতা তো সরকারের নেই। বিভিন্ন খাতে কর ছাড়ের দাবি বরং জোরালো হচ্ছে। অর্থনীতিতে মন্দা অব্যাহত থাকলে রাজস্ব আহরণে গতি সঞ্চার করাও কঠিন। বিদেশি ঋণ-সহায়তা পাওয়াও এখন সহজ নয়। এ অবস্থায় এডিপিতে ব্যাপক কাটছাঁট করেই হয়তো সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে সরকারের আয়-ব্যয়। তাতে আবার কর্মসংস্থান ও নতুন বিনিয়োগের গতি হবে মন্থর। এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিরতার উপাদান জোরালো হচ্ছে। সেটাও বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক। এ ক্ষেত্রে সংকট থেকে উত্তরণের ধারা জোরদার হওয়াই কাম্য। তার সুপ্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। বাজেট বাস্তবায়নও হবে সহজতর। রাজস্ব কার্যক্রম ও ঋণ-সহায়তাপ্রাপ্তি স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকলে সামাজিক সুরক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় নির্বাহও সহজতর হবে। আলোচ্য খাতে দীর্ঘ দিন ধরে উঠতে থাকা প্রশ্নগুলোর নিষ্পত্তিতেও তখন মনোনিবেশ করতে পারবে সরকার।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.