সব প্রক্রিয়া শেষেও ৪ লাখ ৮১ হাজার আবেদনকারী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছ থেকে চালকের সনদ বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড পাচ্ছেন না। কারণ, সংস্থাটির ঠিকাদার কার্ডগুলো সরবরাহ করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড ছাড়া সরকারি চাকরিতে আবেদন করা যায় না। বেসরকারি চাকরিতে অনেক ক্ষেত্রেই ভোগান্তি হয়। বিদেশে যানবাহনের চালক হিসেবে কাজের খোঁজে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই কার্ড লাগে।
অবশ্য বিআরটিএর পক্ষ থেকে ‘ই-পেপার ড্রাইভিং লাইসেন্স’ নামের একটি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ব্যবস্থাটি এমন যে চালক হিসেবে বিআরটিএর পরীক্ষায় পাস করার পর টাকা জমা দিলে অনলাইনে কিউআর কোড–সংবলিত একটি কাগজ প্রিন্ট করতে পারবেন গ্রাহক।
এতে লেখা থাকে, স্মার্ট কার্ড না পাওয়া পর্যন্ত এটি বৈধ লাইসেন্স। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাগজটি দেখালে যানবাহন চালাতে দেওয়া হবে বলে বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন।
নতুন আবেদনকারীদের স্মার্ট কার্ড সরবরাহের দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদার ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি)। বিআরটিএর তথ্য অনুসারে, মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের কাছে গত ১৬ মার্চ পর্যন্ত আবেদন জমা ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার। আর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) আগে থেকে জমে থাকা ১২ লাখ ৪৫ হাজার স্মার্ট কার্ড দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিল। তারা এসব কার্ড দেওয়ার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। তবে এখনো ১ লাখ ৭১ হাজার আবেদনকারী স্মার্ট কার্ড পাননি।
স্মার্ট কার্ড জমে থাকার বিষয়টি গত সোমবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ঈদযাত্রার প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে আলোচনায় আসে। সূত্র জানায়, তখন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেওয়া হয়। জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ঋণপত্র (এলসি) খোলার জটিলতার কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয়সংখ্যক কার্ড দিতে পারেনি। তারা দ্রুত কার্ড আমদানির উদ্যোগ নিয়ে বিষয়টি বিআরটিএর কাছে নথিপত্র দিয়ে জানিয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিষয়টির দ্রুত সমাধান হবে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান আরও বলেন, বিএমটিএফ যেসব কার্ড দিতে পারেনি, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন সমস্যা রয়েছে। তারা দায়িত্ব পাওয়ার আগে যে ঠিকাদার ছিলেন, সেই ঠিকাদার চালকদের অসম্পূর্ণ তথ্য নিয়েছেন। কিছু তথ্য পাওয়াও যায়নি। এসব কার্ডের বিপরীতে নতুন করে তথ্য নেওয়া হবে। তারপর কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চুক্তির তুলনায় কার্ড কম
৫ বছরের মধ্যে ৪০ লাখ স্মার্ট কার্ড সরবরাহের জন্য মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের সঙ্গে বিআরটিএ চুক্তি করে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই। চুক্তি মূল্য ১২০ কোটি টাকা। প্রতিটি কার্ডের দাম ধরা হয়েছে ৩০০ টাকা ৬৫ পয়সা। বিআরটিএ সূত্র বলছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ১৬ মার্চ পর্যন্ত মাদ্রাজ প্রিন্টার্স ৫ লাখ ৫৫ হাজার কার্ড দিতে পেরেছে।
দরপত্রের শর্ত অনুসারে, চুক্তি সইয়ের প্রথম বছরই মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের ৯ লাখ লাইসেন্স সরবরাহ করার কথা। পরের বছর দেওয়ার কথা ৭ লাখ। তৃতীয় বছরে সাড়ে ৭ লাখ, চতুর্থ বছরে আট লাখ ও শেষ বছর সাড়ে আট লাখ লাইসেন্স সরবরাহের কথা তাদের।
বিআরটিএর সূত্র জানায়, অনেক সময় চাহিদা বেশি থাকার কারণে চুক্তিতে নির্ধারিত সময়ের আগেই বেশি কার্ড সরবরাহ করতে হয়। এ জন্যে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের সঙ্গে কার্যাদেশের শর্ত ছিল, দৈনিক গড়ে আট হাজার লাইসেন্স সরবরাহের সক্ষমতা থাকতে হবে। অর্থাৎ প্রয়োজন হলে দুই বছরেই যাতে সব কার্ড ঠিকাদার সরবরাহ করতে পারেন, সেই সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু মাদ্রাজ প্রিন্টার্স প্রয়োজন অনুযায়ী কার্ড দিতে পারছে না।
জানতে চাইলে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক আশরাফ বিন মুস্তফা বলেন, কার্ড আমদানির ঋণপত্র বন্ধ থাকার কারণে তাঁরা লাইসেন্স দিতে পারছেন না। ঋণপত্র না খুলে বিকল্প ব্যবস্থায় সরাসরি আমদানির একটি চেষ্টা চলছে।
মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের আগে লাইসেন্স সরবরাহের কাজটি করছিল বাংলাদেশের টাইগার আইটি। তারা ফ্রান্সের একটি কোম্পানির সহায়তা নিয়েছিল। বাড়তি চাহিদার কারণে টাইগার আইটি নির্ধারিত সময়ের আগেই চুক্তির ১৫ লাখ কার্ডের প্রায় সব সরবরাহ করে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিষয়টি আগে থেকে বিবেচনায় নিয়ে চুক্তি নবায়ন বা নতুন ঠিকাদারকে দায়িত্ব না দেওয়ায় শেষের দিকে ১২ লাখ ৪৫ হাজার আবেদন জমে যায়। এ জন্য ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত লাইসেন্স প্রার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
নতুন ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের এসব কার্ড সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু তারা বিআরটিএকে জানায়, টাইগার আইটির তথ্যভান্ডার থেকে কার্ড প্রিন্ট করা যাচ্ছে না। টাইগার আইটির বিরুদ্ধে যথাসময়ে তথ্যভান্ডার বুঝিয়ে না দেওয়ারও অভিযোগ ছিল। এই পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট পুরোনো আবেদনের বিপরীতে কার্ড বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় বিএমটিএফকে।
আঙুলের ছাপ দিতেও ভোগান্তি
চালকের লাইসেন্স পেতে হলে প্রত্যেককে আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হয়। সঙ্গে সশরীর গিয়ে ছবি তুলতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি ‘বায়োমেট্রিক’ নামে পরিচিত।
ঢাকার মিরপুরে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের বায়োমেট্রিক দেওয়ার কেন্দ্রেও ভোগান্তির অভিযোগ উঠেছে। সেবা গ্রহীতারা বলছেন, নির্ধারিত তারিখে গিয়ে বায়োমেট্রিক দিতে না পেরে ফিরে আসার ঘটনা ঘটছে। লম্বা লাইন এড়াতে কেউ কেউ দালালদের টাকা দিচ্ছেন।
ঢাকায় এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করেন মো. আহসান উল্লাহ। তিনি বলেন, তিনি গত বছর অক্টোবরে লাইসেন্স পেতে প্রয়োজনীয় টাকা জমা দেন। গত ১০ জানুয়ারি বায়োমেট্রিক দিতে গেলে জানানো হয় ২৪ জানুয়ারি আসতে হবে। ওই দিন গেলে ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখ দেওয়া হয়। সেদিনও তিনি বায়োমেট্রিক দিতে পারেননি।
সোয়েব আহমেদ ও তানভীর আহমেদ নামে কিশোরগঞ্জের দুই ব্যক্তি ঘুষের বিনিময়ে আগে বায়োমেট্রিক নেওয়ার প্রস্তাব ও মারধরের অভিযোগে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের কর্মীদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন। এ ঘটনায় মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের সাতজনকে পুলিশ আটকও করেছিল।
বিষয়টি তদন্তের জন্য বিআরটিএর ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি তদন্তে বায়োমেট্রিক নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং মামলায় উল্লেখিত মারধরের ঘটনার সত্যতা পায়।
জানতে চাইলে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক আশরাফ বিন মুস্তফা মামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্বীকার করেন।