চীন যে নতুন পররাষ্ট্রনীতিতে চলছে, এটি হচ্ছে তার একটি মাত্র উদাহরণ। গত ১০ মার্চ চীনের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের দুই বৈরী দেশ ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়েছে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রথম হস্তক্ষেপ। এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে, ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানের ২০ বছর পর ওই অঞ্চলে পশ্চিমাদের আধিপত্য কমেছে। গত ১৫ মার্চ ‘গ্লোবাল সিভিলাইজেশন’ নামের উদ্যোগ উন্মোচন করেন সি চিন পিং। এতে বলা হয়েছে, অন্যদের ওপর নিজস্ব মূল্যবোধ ও মডেল চাপিয়ে দেওয়া এবং মতাদর্শগত সংঘাত থেকে দেশগুলোকে বিরত থাকতে হবে।
চীনের এ দৃষ্টিভঙ্গি আরোপিত নয়, তবে তা কাঠামোগত ও মতাদর্শিক। বিপ্লবী নেতা দেং জিয়াওপিং চীনা নাগরিকদের বলতেন, ‘নিজের শক্তি গোপন রাখো, সর্বোচ্চ সময় পর্যন্ত টিকে থাকা নিশ্চিত করো।’ তবে চিন পিং চান ১৯৪৫ সাল-পরবর্তী বৈশ্বিক ধারাকে বদলে দিতে। এখন নতুন নতুন স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দীর মতাদর্শিক ভাষাগুলো পাল্টাচ্ছে চীন। দেশটি চাইছে ‘বহুপক্ষবাদ’-এর ভিত্তিতে বিশ্বকে সাজাতে, যেন প্রভাবশালী দেশগুলোর স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। বহুপক্ষবাদ হলো একটি অভিন্ন লক্ষ্য অনুসরণকারী একাধিক দেশের জোট।
চীনের সামরিক হুমকি মোকাবিলার কথা বলে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো প্রতিরোধে ‘গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ’ নামে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর ‘গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিজনিত মডেলের প্রসারে কাজ করছে। এ মডেলের মধ্য দিয়ে কোনো শর্ত আরোপ ছাড়াই কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর সঙ্গে লেনদেন করে চীন। ‘গ্লোবাল সিভিলাইজেশন’ নামের প্রস্তাবে যুক্তি দেখানো হয়েছে, জিনজিয়াং এবং অন্যান্য জায়গায় পশ্চিমা দেশগুলো যে সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তা নতুন ধরনের উপনিবেশবাদ।
পরিবর্তিত এ বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের অনেকের সমর্থন আছে, যা ধারণার বাইরে।
চলতি মাসের শেষের দিকে সির সঙ্গে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার বৈঠকের কথা ছিল। তবে সিলভার অসুস্থতার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। সম্ভাব্য সে বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলভা বহুমুখী বিশ্ব গড়ার পক্ষের মানুষ। তিনি চান, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আলোচনার ক্ষেত্রে চীন সহযোগিতা করুক।
অনেকে মনে করেন, ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈতনীতি প্রকাশ পেয়েছে। আর চীন এ বিষয়ের ওপরই জোর দিচ্ছে। ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আবারও সম্পর্ক বাড়াচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে এশিয়াকে প্রাধান্য দেওয়ায় মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তানসহ অন্যান্য অঞ্চলে সম্পৃক্ততা কমে যাচ্ছে।
ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের পদক্ষেপ বেছে নিয়েছে। তবে অনেক দেশই এ যুদ্ধের বিরোধী। তারা এ যুদ্ধের অবসান চায়। কমপক্ষে ১০০টি দেশ পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেনি। মোট বৈশ্বিক জিডিপির ৪০ শতাংশ এসব দেশ থেকে আসে। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী রন ডিস্যান্টিস কেউ-ই ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের মূল স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করে না। এতে তুরস্ক থেকে শুরু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সর্বোপরি চীনের জন্য জায়গা তৈরি হবে।
চীনের বার্তা হলো, প্রকৃত গণতন্ত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অঙ্গীভূত করে। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করে না। এ বার্তাকে অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর অভিজাত ব্যক্তিরা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন।
তবে চীন যে মুনাফাভিত্তিক বহুপক্ষবাদের লক্ষ্যে হাঁটছে, তা আদৌ পূরণ হবে কি না, মূল্যায়ন করা জরুরি।
১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর থেকে ইরান ও সৌদি আরব একে অপরের ঘোর শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই দুই দেশের জন্যই চীন সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। এ কারণে তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধ প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকে বেইজিং। চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে হয়তো ইয়েমেনে এ দুটি দেশের ছায়াযুদ্ধের মাত্রা কমে আসতে পারে। ইয়েমেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত তিন লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এ চুক্তির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর প্রভাবও কমতে পারে।
তবে সি চিন পিংয়ের পররাষ্ট্রনীতির মূল জায়গা হলো বিশ্বকে চীনা কমিউনিস্ট দলের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ রাখা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ নীতিমালার ত্রুটিগুলো আড়াল করা কঠিন হবে। নতুন নতুন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়তে গিয়ে চীনকে পরস্পরবিরোধী অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে।
চীন ইরানকে সমর্থন দিয়েছে। তেহরানের চলমান পারমাণবিক তৎপরতাকে উপেক্ষা করছে তারা। অথচ ইরানের এই পারমাণবিক তৎপরতার কারণে ওই অঞ্চলে চীনের অন্য বন্ধুদেশগুলোর জন্য যে হুমকি তৈরি হচ্ছে, সেদিকে নজর দিচ্ছে না। ইউক্রেনে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে চীনকে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের সম্মতি নিতে হবে। যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় জবাবদিহির বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে জড়িত। আরেকটি হামলা না হওয়ারও নিশ্চয়তা দিতে হবে।
ইউক্রেন কিংবা তাইওয়ান—যে অঞ্চলই হোক না কেন, চীন তিনটি বিষয় উপেক্ষা করে থাকে। এসব অঞ্চলের গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা মহাশক্তিধর দেশগুলোকে প্রতিরোধের নীতিতে বিশ্বাস করে না চীন। ভারত ও জাপানের মতো যেসব দেশ সরাসরি চীনের নিরাপত্তাজনিত হুমকিতে আছে, সেগুলো আরও বেশি সতর্ক হয়ে উঠবে। কারণ, একটি দেশের প্রতিবেশী যদি শক্তিশালী ও আগ্রাসী হয়, তাহলে আতঙ্ক বাড়ে।
চীন প্রায় সব সময়ই ক্ষমতাসীন অভিজাত ব্যক্তিদের সমর্থন দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে যাঁদের সমর্থন দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা অযোগ্য বা নিষ্ঠুর কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। চীনের এমন ভূমিকা ধীরে ধীরে বিশ্বের সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি করতে পারে।
বৈশ্বিক নানা নীতি শুধু পশ্চিমা স্বার্থকে রক্ষা করে, এমন সব অভিযোগকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং চীন ও রাশিয়া যে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছে, তার প্রকাশ করাটাই হবে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য।
১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল, দীর্ঘস্থায়ী জোট গঠন ও সাধারণ নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে তারা নিজেদের আরও বেশি করে নিরাপদ করতে পারবে। তবে গত কয়েক দশকে ইরাকসহ বিভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তবে দুই নেতার মস্কো সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যা প্রকাশ পেয়েছে, তা এর চেয়ে খারাপ। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভালোবাসা জয় না করেই একটি শক্তিধর দেশ প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। আস্থা অর্জন ছাড়াই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে চাইছে। সর্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত না করেই বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে।
যাঁরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব ভালো একটি জায়গায় পৌঁছাতে পারবে, তাঁদের আরও একবার ভেবে দেখা উচিত।