* ব্যাংকে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ ৩ পরিচালক
* খেলাপিদের তালিকা না দিলে ব্যাংককে জরিমানা
* জামানত ছাড়া ব্যাংক পরিচালকদেরও ঋণ নয়
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক হিসেবে এক পরিবারের তিনজনের বেশি সদস্য থাকতে পারবেন না। বিদ্যমান আইনে চারজন সদস্য থাকতে পারেন। অন্যদিকে, ইচ্ছাকৃত ব্যাংক ঋণখেলাপিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে আইন সংশোধনে বেশ কিছু নতুন প্রস্তাবের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এখন ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২৩’ এর খসড়া জাতীয় সংসদে পাঠানো হবে।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হোসাইন খান। মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর এ-সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলন মন্ত্রিপরিষদ সচিব করে থাকেন। কিন্তু গতকাল রাষ্ট্রপতির প্রটোকল-সংক্রান্ত কাজে তিনি ব্যস্ত ছিলেন বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
মাহমুদুল হোসাইন খান জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী এক পরিবার থেকে তিনজনের প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃত ব্যাংক ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সামর্থ্য থাকার পরও যদি ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণ, অগ্রিম বা বিনিয়োগ বা আর্থিক সুবিধার অংশ বা তার ওপর আরোপিত সুদ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ না করে তাহলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবে।
একই সঙ্গে যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, প্রাপ্ত ঋণ সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করলেও ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। জালিয়াতি বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করলে সেটাকেও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরবরাহ করবে জানিয়ে সচিব বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। এ ছাড়া ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) কাছে কোম্পানি নিবন্ধনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি যথাযথভাবে ঋণমুক্ত হওয়ার পরপরই কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর পরিচালক হতে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই সময় পাঁচ বছরের বেশি হবে না। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপির আওতায় পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁর পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নোটিশ প্রদানের দুই মাসের পাওনা টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা যাবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান না পাঠায় তাদের ৫০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা না পাঠালে পরবর্তী দিনপ্রতি ১ লাখ টাকা করে জরিমানা অব্যাহত থাকবে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা তাঁর আত্মীয় যেই হোন না কেন, তাঁকে অবশ্যই জামানত, বন্ড বা সিকিউরিটি দিয়ে ঋণ নিতে হবে। অর্থাৎ ব্যাংক পরিচালক বা পরিচালকের সদস্য কর্তৃক দায় গ্রহণের ভিত্তিতে জামানতি ঋণ, অগ্রিম ঋণ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা প্রদান করবে না। ঋণগ্রহীতা যেই হোন, ঋণের বিপরীতে জামানত বা বন্ধক থাকতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক কোম্পানির অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বা ফাউন্ডেশন যেন বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত পর্যবেক্ষণ আইনের সংশোধনে সেটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০১৮ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের আগে এক পরিবার থেকে একই ব্যাংকে সর্বোচ্চ দু’জন পরিচালক থাকার সুযোগ ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি এবং অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা সত্ত্বেও ওই সংশোধনীর মাধ্যমে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবার বলতে কোনো ব্যক্তির স্ত্রী, স্বামী, পিতামাতা, পুত্র, কন্যা, ভাইবোন এবং ওই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সবাইকে বোঝায়। বর্তমানে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকার সুযোগ থাকলেও খুব কম ব্যাংকে তা আছে। মূলত কোনো ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে সুশাসন বিঘ্নিত হয়। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিশিষ্টজন একাধিক পরিচালক রাখার বিপক্ষে মত দিয়ে থাকেন।
ভূমির করের তালিকা টানানো হবে : গতকালের মন্ত্রিসভায় ‘ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০২৩’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হলে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ভূমি অফিসের সামনে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূমি উন্নয়ন কর-সংক্রান্ত তথ্য সাইনবোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের বর্ষপঞ্জি পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। নতুন আইনে অর্থবছর অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন মেয়াদে ভূমি উন্নয়ন কর অবশ্যই ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে। বর্তমানে ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র, অর্থাৎ বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী কর আদায় হয়।