পণ্যের বাজারে রয়েছে দুষ্টচক্র: সিপিডি

0
181
সিপিডির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নিয়ে সীমিত সংখ্যক ‘প্লেয়ার’ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এর সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো কৌশলই কাজ করছে না। বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ছোট প্রতিষ্ঠানকে খেয়ে ফেলছে। বাজারে ছোটদের প্রভাব এবং অংশগ্রহণ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাড়ছে বড়দের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব। এ ছাড়া পণ্যের বাজারে রয়েছে দুষ্টচক্র।

জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ সিপিডির সুপারিশ উপস্থাপন উপলক্ষে আজ সোমবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনায় এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। রাজধানীর ধানমন্ডির সিপিডি কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

এতে সিপিডির পর্যবেক্ষণ এবং আগামী বাজেটে সুপারিশ তুলে ধরেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান, রিসার্চ ফেলো মুনতাসির কামাল ও সৈয়দ ইউসুফ সাদাত সংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, মূল্যস্ফীতির হিসাবের সঙ্গে বাজারের মিল নেই। গত ফেব্রুয়ারির মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অথচ কোনো কোনো পণ্যের দাম ৩০ শতাংশেরও বেশি। মাছ-মাংসের দর ২৫ শতাংশ বেড়েছে। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের যে উল্লম্ফন ছিল, তা কমে এসেছে। সব পণ্যের দামে এখন নিম্নগতি, তবে দেশে কমছে না। আমদানি পণ্য ছাড়াও দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। চাল দেশেই উৎপাদন হয়। তবে ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশি। সয়াবিনের দাম বরাবরই বেশি ছিল। এখনও দাম বাড়তি। চিনির দাম ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। পদক্ষেপ হিসেবে অনেক পণ্যে সরকার শুল্ক কমিয়েছে অথচ বাজারে এর সুফল নেই। গরুর মাংস দেশের পণ্য। অথচ বিশ্ববাজারের চেয়ে দেশে দাম অনেক বেশি।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কীভাবে চলছে সাধারণ মানুষ– সে বিষয়ে এক পরিসংখ্যান তুলে সিপিডির উপস্থাপনায় বলা হয়, ঢাকা শহরের চারজনের একটি পরিবারে প্রতি মাসে শুধু খাবারের পেছনে খরচ ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। খাবারে আপস করলে অর্থাৎ মাছ-মাংস বাদ দিলে এই খরচ দাঁড়ায় ৭ হাজার ১৩১ টাকা। এই হিসাব গত ফেব্রুয়ারি মাসের। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ খরচ ছিল ১৮ হাজার ১১৫ টাকা। খাবারের তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে খেলে সেই খরচ ছিল ৫ হাজার ৬৮৮ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি খাবারের খরচ বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

ড. ফাহমিদা মনে করেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতির জন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক কারণকে সরকারের তরফ থেকে দায়ী করা হয়। অথচ এখন আর এ অজুহাত দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং সংস্কার ও সুশাসনের ঘাটতি এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা দুর্বলতাই এর জন্য দায়ী। নীতিমালা, সুশাসনের ঘাটতি এবং বিভিন্ন খাতে সংস্কার না হওয়ার কারণেই এ রকম হচ্ছে।  এ ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ অনেক চ্যালেঞ্জে রয়েছে অর্থনীতি। এ কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাজস্ব আহরণ স্বস্তিদায়ক নয়। রাজস্ব আদায় গত ছয় মাসে আগের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ কম। বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা কম হবে এ বছর। বাজেট ঘাটতি এখনও অনেক বেশি। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি ধীর হয়ে এসেছে। বিদেশি ঋণ এবং অর্থায়নও নেতিবাচক। তারল্য সংকটে বেসরকারি ব্যাংক  চাহিদা মতো ঋণ দিতে পারছে না। অর্থনীতির অন্যান্য সংকট হিসেবে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবনমন, প্রবাসী আয় কমেছে। বিদেশি ঋণের প্রবাহ কমেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক।

সিপিডির সুপারিশমালায় বলা হয়, বিনা প্রশ্নে ৭ শতাংশ করের মাধ্যমে পাচারের টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ আগামী বাজেটে বন্ধ করতে হবে। কারণ, এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন। এ ছাড়া কালোটাকা সাদা করার সুযোগও বন্ধ করা এবং ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন করার সুপারিশ করেছে সিপিডি।

ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সমালোচনায় সিপিডি বলেছে, বিদ্যুতের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রতি মাসে একবার পর্যালোচনা করা উচিত। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ প্রথা বাতিল করে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে’ ব্যবস্থায় যাওয়া দরকার।

সিপিডি মনে করে, আগামী বাজেট প্রণয়নে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য, রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবণতা, উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারসাম্য ঘাটতি, নিম্নগামী রিজার্ভ— এই ছয়টি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির মধ্যে কার্যকর সমন্বয়, সুশাসন ও শৃঙ্খলা আনতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা, শৃঙ্খলা ও সুসংহত দরকার। নির্বাচনের বছর হিসেবে কতটা সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া যাবে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। এসব পদক্ষেপের জন্য উচ্চপর্যায় থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছারও প্রয়োজন রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.