বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশনা অনুযায়ী, পাকিস্তান আমল থেকেই নিরাপত্তার কারণে স্টেট ব্যাংকের ভল্টের চাবি একাধিক কর্মকর্তার কাছে কাছে রাখার বিধান ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ওপর কোনো ধরনের হামলার ঘটনা ছিল না। তখন ব্যাংকের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী নিয়োজিত ছিল। আর ভল্ট সুরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পুলিশ বাহিনী।
তবে মুক্তিযুদ্ধ তখন শেষ দিকে, বিজয় দ্বারপ্রান্তে। অর্থাৎ একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের ঠিক একদিন আগে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টের টাকা পোড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন দেশকে অচল করে দেওয়া। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্দেশে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের (তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নাম ছিল) ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বগুড়া শাখার ভল্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিভিন্ন স্থান থেকে তলব করা হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে মতিঝিল অফিসের তৎকালীন ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) এ ও এম সামসুদ্দোহা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট রক্ষায় কিছু কৌশল করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও দুই কর্মকর্তা মো. আজিজুল হক এবং হামিদুর রহমান। তাঁরা ডল্ট থেকে প্রথমে অচল ও কম মূল্যমানের নোটের বস্তা সামনে আনার ব্যবস্থা করেন। সেই নোটের বস্তাই পাকিস্তান সেনারা পুড়িয়ে ফেলেন। কিছুক্ষণ পোড়ানোর পরে সেনাবাহিনী টাকার স্তূপ আধপোড়া অবস্থায় রেখে চলে যায়। এতে নতুন নোটগুলো অক্ষত থাকে। তবে এ সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হলে কিছু মানুষ বেশ কিছু নোট সরিয়ে ফেলেছিলেন।
চট্টগ্রাম অফিসের ব্যবস্থাপক তছির উদ্দিন আহমদও ভল্ট রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে সে সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকায় আনা হয়। চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি মারা যান। আর বগুড়া অফিসের ব্যবস্থাপক মজিদ মোল্লা পাকিস্তানি সেনাদের হুমকির মুখে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
টাকা পোড়ানো নিয়ে পুলিশের ভাষ্য
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের প্রহরায় বরাবরই পুলিশ বাহিনী নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের মতিঝিলের কার্যালয় আক্রমণের ঘটনা সম্পর্কে ১৯৭১ সালে ঢাকা শহরের দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী গোলাম রহমানের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ডেপুটি গভর্নরের কার্যালয়টি অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যান।
ব্যাংক ত্যাগের আগে তাঁরা ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে, ভল্টের বাইরে ও ভল্টে রক্ষিত নোট ফ্লোরে ফেলে আগুন লাগিয়ে দেন। তিনি মোবাইল ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে সেখানে পৌঁছান, সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত ড্রাইভার কামাল (ল্যান্স নায়েক পদমর্যাদার)। অস্ত্র বলতে নিজের কাছে ছিল একটি রিভলবার আর ড্রাইভারের কাছে একটি স্টেনগান। ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনি ভিড় করে থাকা লোকজন সড়াতে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়েন। ব্যাংকে ঢুকে দেখেন কোথাও ধোঁয়া উড়ছে, কোথাও আধপোড়া নোট, আবার কোথাও পোড়া দাগ লাগা নোট পড়ে আছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে কেউ ছিল না।
ভেতরের অবস্থা দেখে তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন এবং ড্রাইভারের সঙ্গে আলোচনা করেন। ড্রাইভার কামাল একটু ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, জায়গাটা পাহারা দেব, তবে পড়ে থাকা টাকা থেকে ভালো টাকাগুলো জিপে তুলে নিই। বাকি জীবন আপনারও কিছু করতে হবে না, আমারও না।’ ঘটনাস্থলে যেহেতু আর কেউ ছিল না তাই গোলাম রহমান ড্রাইভার কামালের ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না এবং বিপদের আশঙ্কা করছিলেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি তখন কৌশলের আশ্রয় নেন। কাছে ডেকে এনে ড্রাইভারের কাঁধ থেকে স্টেনগানটি নিজের হাতে নিয়ে নেন। তারপর পাঠিয়ে দেন রাজারবাগে, বাড়তি পুলিশ ও রাইফেল আনার জন্য। এরপর রাজারবাগ থেকে আনা লোকবল দিয়ে গোলাম রহমান ব্যাংক ভবন ঘেরাও করে রাখার নির্দেশ দেন, যাতে বহিরাগত কেউ ব্যাংকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে কিংবা টাকা লুট করে পালাতে না পারে।
এরপরের ঘটনাটি হলো ১৫ ডিসেম্বর লুট হয়ে যাওয়া নোট উদ্ধারের ঘটনা। তখন দেশ স্বাধীন। তখন সমন্বিত বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে পুরো কমলাপুর বস্তিতে এক উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। অভিযান চালিয়ে কমলাপুর বস্তি থেকে আধপোড়া, কোনা পোড়া, পোড়া দাগ লাগা দুই বস্তাসহ কয়েক বস্তা টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল।
বগুড়া ও খুলনার ভল্ট লুট
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল বগুড়া অফিসের ভল্ট থেকে টাকা লুট হয়েছিল। আর অক্টোবর মাসে খুলনা অফিসে ভল্ট লুটের ঘটনা ঘটে। এসব লুটের সঙ্গে কিছু বিপথগামী কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি স্থানীয় কিছু সুবিধাভোগী লোকও জড়িত ছিল। অবশ্য কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী লুট করা অর্থ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিল বলেও জানা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্যাংকের শাখা লুট নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য হলো কোনো কোনো শাখায় যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাংক লুট করেন, আবার কোথাও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ব্যাংক লুট করে পালিয়ে যায়।
অবশ্য কোনো কোনো শাখায় দুষ্কৃতকারীরা এককভাবে বা কোনো বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে টাকা লুট করেছে বলে তথ্য রয়েছে। একটি তথ্য বলছে, এ ধরনের আক্রমণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বগুড়া অফিসের ভল্ট থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা লুট হয়। আর মৌলভীবাজারে ব্যাংক আক্রান্ত হওয়ার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পালিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা গ্রেনেড হামলা করে ব্যাংক লুট করে। আবার কিছু জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সদস্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ট্রাকে করে টাকা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও ভারতের আগরতলায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশ সরকার পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে লুট করা প্রায় ৩০ কোটি টাকা উদ্ধার করতে পেরেছিল।
ব্যাংকের টাকা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের কাজে
আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যাংক থেকে পাকিস্তানি টাকা ভারতে বিএসএফের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যাংকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টাকা ছাড়াও কিশোরগঞ্জের ব্যাংকগুলো থেকে পাঠানো টাকা জমা ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুটি ব্যাংকে টাকা রাখা হয়। একটি ব্যাংকের ভল্টে ছিল ১০ কোটি টাকা, আরেকটি ব্যাংকের ভল্টে ছিল ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বোমা নিক্ষেপ করা শুরু করে, তখন মুক্তিবাহিনী বুঝতে পারে যে তাদের পক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে টাকা ভারতে স্থানান্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন মনে করেন, যে ব্যাংকে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা মজুত ছিল, সেটি সব ব্যাংকের মজুত। তিনি ১০ কোটি টাকার মজুত স্থানান্তরের কোনো উদ্যোগই নেননি। তিনি বিএসএফের কাছে ৮০ লাখ টাকা হস্তান্তর করতে সমর্থ হন। ৩৪ লাখ টাকার হিসাব মেলানো সম্ভব হয়নি। আইনউদ্দিন দাবি করেন যে শুধু ১০০ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোটে ভারতীয় বাহিনীর কাছে যে অর্থ জমা দেওয়া হয়, তা হিসাব করা হয়েছিল। ১ টাকা, ৫ টাকা এবং ১০ টাকার নোটে যে অর্থ আনা হয়, তা হিসাব করা হয়নি। তাই হিসাবে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে।’
এরপর আকবর আলি খান আরও লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টাকা হস্তান্তরে সমস্যা হওয়ায় আমরা সতর্ক হয়ে যাই। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিই যে হবিগঞ্জে ন্যাশনাল ব্যাংকে যে টাকা রয়েছে, সে টাকা বিএসএফের কাছে পাঠাতে হবে। এ টাকা পাঠানোর জন্য আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাহায্য চাই। টাকা স্থানান্তরের কাজটি তত্ত্বাবধানের জন্য আমি হবিগঞ্জে যাই। হবিগঞ্জের ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজার বলেন, একমাত্র এসডিও হুকুম দিলে তিনি টাকা সেনাবাহিনীকে দেবেন, অন্যথায় টাকা কোনোমতেই দেওয়া যাবে না। আমি অফিস থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজারকে সেনাবাহিনীর কাছে টাকা দেওয়ার জন্য আদেশ দিই। সেনাবাহিনী ট্রাকে করে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে হবিগঞ্জ থেকে এ টাকা আগরতলায় নিয়ে যায়। রাঙামাটি থেকে ট্রেজারির অর্থ তুলে নিয়ে আসেন জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম। এ ছাড়া পাবনা থেকে নুরুল কাদের খান বাংলাদেশ সরকারের কাছে টাকা জমা দেন, ঝিনাইদহ থেকে এসডিপিও মাহবুব, মেহেরপুর থেকে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের কাছে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা জমা দেন।
আবার কিছু অসফলতার কথাও আকবর আলি খান বলেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রায় সব মহকুমা থেকেই ট্রেজারির টাকা ভারতীয় বিএসএফের কাছে হস্তান্তরের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সব জায়গায় সেটি সফল হয়নি। কোথাও কোথাও অনেক টাকা লোপাট হয়ে গেছে। বগুড়ায় ৩২ কোটি টাকা ছিল। এর একটি ক্ষুদ্র অংশ বিএসএফের কাছে পৌঁছায়। আর একটি অংশ একজন অভিনেতা তাঁর শিষ্যদের নিয়ে দখল করেন। এ অর্থ নিয়ে ভারতে তিনি অনেক কেলেঙ্কারির জন্ম দেন। এ অর্থে নাকি এক রাজনৈতিক নেতাও ভাগ বসিয়েছিলেন।
মৌলভীবাজার ট্রেজারির কর্মকর্তারা ভল্টের চাবি নিয়ে গ্রামে পালিয়ে যান। বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট গ্রেনেড দিয়ে ভল্ট ভাঙে। কিন্তু এখানেও টাকার হিসাব মেলেনি। ওই দিন মৌলভীবাজারের একটি চা-বাগানে আমি রাত যাপন করেছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি রাস্তার ওপরে বেশ কিছু নোট পড়ে আছে। টাকা হস্তান্তরে অনিয়ম সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবনগর সরকার ও হান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে ১৬/৮/৭১ সালে একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। তবে এই কমিশনের কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।’