আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে বিশ্বাস করছে না। তাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থা কীভাবে নিরসন করা সম্ভব, তা জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিস্থিতির উত্তরণ কীভাবে সম্ভব, তার উপায়ও জানতে চায় দেশটি।
গতকাল বুধবার আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্মানে রাজধানীর গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের বাসভবনে এক মধ্যাহ্নভোজের ফাঁকে আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। এ সময় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেছেন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
পরে বৈঠক নিয়ে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এক টুইট বার্তায় জানায়, ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। বৈঠকে বাংলাদেশে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য, যোগাযোগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন, আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এবং নির্বাচনকালে সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বৈঠকে আন্তরিক কথাবার্তা হয়। বৈঠকটি সফল হয়েছে।
বৈঠকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে নন। কে ক্ষমতায় এলেন কিংবা গেলেন– সেটাও তাঁদের বিবেচ্য বিষয় নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রসঙ্গও তাদের ইস্যু নয়। তাঁরা একটি ভালো নির্বাচন প্রত্যাশা করেন। সব দলের অংশগ্রহণের মতো সহায়ক পরিবেশের আশা করেন। তবে এসব ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নাক গলাবে না যুক্তরাষ্ট্র।
এ সময় আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব। এটা সংবিধানে নেই। তাই আওয়ামী লীগ সংবিধানের ভেতরে থেকেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। আর বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাদের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে বলে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তাঁরা রাষ্ট্রদূতকে জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল আওয়ামী লীগের দাবি। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে এই ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করেছিল বিএনপি ও ওয়ান ইলেভেন সরকার। বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সরকারের নানা উদ্যোগ তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর আগে কোনো সরকার এটা করেনি।
আস্থাহীনতা দূর করে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য আওয়ামী লীগের ভূমিকা জানতে আগ্রহ দেখান রাষ্ট্রদূত। এ সময় আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিএনপিকে আহবান জানানো হচ্ছে। কিন্তু তারা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে না। কথিত আন্দোলনের নামে বাসে অগ্নিসংযোগ ও রেলপথ উপড়িয়ে মানুষ খুনের মতো বর্বর কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসার পথে হাঁটছে না বিএনপি। তাদের আচরণে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসেনি।
পিটার ডি হাস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে শত্রুভাব রয়েছে। এই চিত্র বাংলাদেশে আরও বেশি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। এ পরিস্থিতি কীভাবে দূর করা যায়? এই বিষয়ে আওয়ামী লীগ কী ভাবছে? রাষ্ট্রদূতের আগ্রহ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা সাম্প্রতিক সময়ে একসঙ্গে চা পান করেছেন কিনা?
এ সময় আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রদূতের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে বলেন. বিএনপি কী সংলাপে বসতে রাজি?
তাঁরা আরও বলেন, রাষ্ট্রপতির ডাকে সাড়া দেয়নি বিএনপি। নির্বাচন কমিশনের সংলাপ বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণের মতো সৌজন্যবোধও দেখাননি বিএনপি নেতারা। নেতারা রাষ্ট্রদূতকে জানান, দেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। জেলখানায় খুন করা হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে। এখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপি স্লোগান দিচ্ছে, ’৭৫ এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। তারা বর্তমান সরকারের বৈধতা মানে না। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতাদের অপমান করে। তারা টেনেহিঁচড়ে সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন বর্জনের কথা বলেছে।
আলোচনার টেবিলে হাস্যরস ও আলাপ জমে ওঠার এক ফাঁকে আওয়ামী লীগ নেতারা রাষ্ট্রদূতকে বলেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্ব নিক বিএনপিকে নির্বাচনে আনার।
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা গণতন্ত্র বিকাশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সোয়া দুইশ বছরের চেষ্টার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, তবুও নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন ছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচএম এরশাদ অবৈধভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তবে দায়িত্বশীল বিরোধী দল থাকলে গণতন্ত্রের বিকাশ আরও মজবুত হতো। কিন্তু ‘নির্বাচনে বিজয়ের নিশ্চয়তা’ দিলেই বিএনপি নির্বাচনে আসবে– এটা তো সম্ভব না। আসলে বিএনপির মানসিকতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো। নির্বাচনে হেরে গেলেই তারা গণতন্ত্র নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন তোলে।
অন্য এক প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে আওয়ামী লীগ। এর জবাবে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা জানান, এটা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ কখনোই মার্কিনবিরোধী নয়। আমেরিকাকে বন্ধু মনে করে আওয়ামী লীগ। সব সময়ই দেশ ও জনগণের স্বার্থে সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখে দলটি। তাছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করে। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করেছেন।
রাষ্ট্রদূত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দেশের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক পাঠানোর আগ্রহ দেখান। এ সময় তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র আগে বিতর্কিত পর্যবেক্ষক পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। তাই আগামী নির্বাচনে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ থাকবে।