নকল ভ্যাকসিনের ভয়ংকর বাণিজ্য

0
204
নকল অ্যাম্পুলে ভরে চলত জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ‘ভ্যাকসিন’

ভারত থেকে অবৈধ পথে এনে মজুত করা হতো হেপাটাইটিস-বি’র আমদানি নিষিদ্ধ ভ্যাকসিন (টিকা)। পরে একটি ভেঙে ১০টি নকল অ্যাম্পুলে ভরে চলত জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ‘ভ্যাকসিন’ হিসেবে সরবরাহের প্রক্রিয়া। সেগুলোর একেকটি বিক্রি হতো আড়াই হাজার টাকায়। ফলে ৩৫০ টাকায় কেনা একটি নিষিদ্ধ টিকা ভিন্ন নামে বিক্রি করে মেলে ২৫ হাজার টাকা। এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে ভয়ংকর এসব তথ্য।

শুধু তাই নয়, ঢাকা ও গাজীপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচারণা ও বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে প্রকাশ্যেই এমন কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল চক্রটি। এই প্রচারণা ও বাজারজাতকরণে ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন, আল নূর ফাউন্ডেশন ও পপুলার ভ্যাকসিনেশন সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানের নামও এসেছে। গত দুই বছরে এই চক্র শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৬ হাজার নারীকে নকল ভ্যাকসিন দিয়েছে। তিন ডোজের মধ্যে প্রত্যেকে গড়ে দুই ডোজ নিয়ে থাকলেও প্রতারকদের পকেটে গেছে অন্তত ৩ কোটি টাকা। আর নকল ভ্যাকসিনের বিষয়টি জানার পর এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ভুক্তভোগীরা। অথচ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এমন প্রতারণার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। কেউ কেউ বলছেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীলদের ‘ম্যানেজ’ না করে এমন কর্মকাণ্ড চলতে পারে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা সংস্থার উপদেষ্টা মোশতাক হোসেন বলেন, দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে কাজ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তাদের সহযোগিতা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মাঝেমধ্যে বাজার থেকে ওষুধ নিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার তা ঠিক আছে কিনা। তবে জনবল সংকটের কারণে অনেক সময় করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ৫ লাখ ৭০ হাজার নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় অন্তত ৩ লাখ ১০ হাজার নারীর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে আসে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৮ হাজার নারী নতুন করে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর প্রতিবছর ১২ হাজার নারীর মারা যাচ্ছেন।

যেভাবে তৈরি হয় নকল ভ্যাকসিন : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁর কার্যালয়ে প্রতারক চক্রের ব্যাপারে সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, হেপাটাইটিস-বি’র ভ্যাকসিন ‘জেনেভ্যাকুবি’ আমদানি করা নিষিদ্ধ। সেটিই ফজর আলী নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করত সাইফুল ইসলাম শিপন। সেগুলো রাজধানীর দক্ষিণখানে নিজের বাড়িতে মজুত করত, পরে তা পাঠিয়ে দিত কেরানীগঞ্জে তার সহযোগী হিমেলের কারখানায়। সেখানে থাকা মেশিনের সাহায্যে ভ্যাকসিনের অ্যাম্পুল খুলে ১ মিলিলিটার করে নকল অ্যাম্পুলে ভরা হতো। এটি বাজারজাত করা হতো জরায়ু ক্যান্সারের ভ্যাকসিন ‘সারভারিক্স’ হিসেবে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে শিপনসহ চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবির তেজগাঁও বিভাগ। অন্য চারজন হলো ফয়সাল আহমেদ, আল আমিন, নুরুজ্জামান সাগর ও আতিকুল ইসলাম। তারা প্রচারণা চালিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছে এই ভ্যাকসিন বিক্রি করে।

তিনি জানান, অভিযানে ১২ বাক্সে মোট ১২০টি জেনেভ্যাকুবি ভ্যাকসিন জব্দ করা হয়। এর বাজারমূল্য ১ লাখ ৯ হাজার ৫৪৮ টাকা। এগুলো দিয়ে অবৈধ উপায়ে ১ হাজার ২০০টি সারভারিক্স ভ্যাকসিন তৈরি করা হতো। সেগুলো বিক্রি হতো ৩০ লাখ টাকায়। এর পাশাপাশি জেনেভ্যাক দিয়ে তৈরি ১ হাজার ২৫টি নকল সারভারিক্স ভ্যাকসিনও জব্দ করা হয়েছে। সেগুলোর বাজারমূল্য ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়াও অভিযানে পাওয়া গেছে ভ্যাকসিনের অ্যাম্পুল তৈরির মেশিন, অ্যাম্পুলের লেবেল ৫০ পাতা (প্রতি পাতায় ৪৫টি লেবেল), ১০০টি খালি অ্যাম্পুল, অ্যাম্পুলের ৫০০টি ছিপিসহ অন্য সরঞ্জাম।

ফাউন্ডেশনগুলোর ভূমিকা কী: ডিবিপ্রধান বলেন, চক্রের সদস্যরা নকল ভ্যাকসিন নিজেরাই বাজারে ছড়িয়ে আসছিল। পাশাপাশি কয়েকটি নামি ফাউন্ডেশনকে ব্যবহার করে গাজীপুর, টঙ্গী ও ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালিয়ে ভ্যাকসিন দিত। কিশোরী ও তরুণীকে তারা ভ্যাকসিনের তিনটি ডোজ নিতে উদ্বুদ্ধ করত। এভাবে তারা প্রতি ডোজ আড়াই হাজার হিসেবে তিন ডোজের জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকা নিয়েছে। এই চক্রে জড়িত আরও বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালানো প্রসঙ্গে ডিবিপ্রধান বলেন, গ্রেপ্তারদের রিমান্ডে নিয়ে আগে জানার চেষ্টা করা হবে, ওই ফাউন্ডেশনগুলো কীভাবে তাদের সঙ্গে কাজ করত। নকল ভ্যাকসিনের প্রচারণাও অপরাধ। সারভারিক্স তিন বছর ধরে আমদানি হয়নি– এটা তাদের জানার কথা। ভ্যাকসিন আমদানি,  প্রচারণা ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে পপুলার ভ্যাকসিনেশন সেন্টারের দায়িত্বরত কর্মকর্তা রাসেল আহমেদ বলেন, নকল ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় ভ্যাকসিন আমদানি ও প্রয়োগ করে থাকি।

ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম রনি বলেন, এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কেনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

যেভাবে ধরা পড়ল প্রতারণা: ডিবির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার গোলাম সবুর  বলেন, কয়েক দিন আগে বনশ্রীতে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর এক নারীর শরীর ফুলে যায়। এতে সন্দেহ হলে তিনি প্রতিবেশীদের নিয়ে ভ্যাকসিন দিতে যাওয়া লোকদের আটক করেন। শেষ পর্যন্ত তারা কৌশলে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়েই এ চক্রের খোঁজ পাওয়া যায়। গ্রেপ্তাররা মূলত প্রতারক। তাদের মধ্যে শিপন টিকাদান কর্মসূচির কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার কাছ থেকে ভ্যাকসিন নিতে অনুরোধ জানাত। এ ছাড়া শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে এবং মাইকিং করেও প্রচারণা চালানো হতো।

ভ্যাকসিন নেওয়া নারীরা আতঙ্কে: নকল টিকা নিয়েছেন এমন কয়েক নারী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাও নিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে এক ছাত্রী বলেন, জরায়ু ক্যান্সার প্রাণঘাতী এক ব্যাধি। তাই এ নিয়ে সব নারী ভয়ে থাকেন। আবার এ নিয়ে আছে সংকোচও। এর মধ্যে একদিন তারা আমাদের কলেজে এসে প্রচারণা চালায়। তাদের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য দুই দফায় পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দুই ডোজ টিকা নিয়েছি। আরও এক ডোজ নেওয়ার কথা ছিল। এখন আমি খুব দুশ্চিন্তায়। টাকা তো গেলই; শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় কিনা– তাই ভাবছি।

ঢাকার বনশ্রীর বাসিন্দা এক গৃহিণী নকল ভ্যাকসিনের কথা শুনে বিস্মিত। তিনি জানান, এলাকায় মাইকিং শুনে তিনি প্রতিবেশী নারীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন। পরে তাঁরা কয়েকজন গিয়ে ভ্যাকসিন নেন। তিনি এ পর্যন্ত দুই ডোজ নিয়েছেন।

আরেক নারী সবে প্রথম ডোজ নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার একবারও সন্দেহ হয়নি– এটা নকল হতে পারে। আমার মতো আরও অনেকেই নিয়েছেন। শারীরিক তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে এখন ভয় লাগছে। তিনি শিগগিরই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন বলে জানান।

কর্তৃপক্ষ যা বলছে: ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ বাজারজাত বন্ধে নিয়মিত আমাদের অভিযান চলে। এ ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণে র‍্যাব-পুলিশ আমাদের মাঝেমধ্যে সহযোগিতা করে। নতুন যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা– আমার জানা নেই।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবির বলেন, নকল টিকা আমদানি ও সরবরাহকারী কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে– এটি গণমাধ্যমে এসেছে। তাদের সঙ্গে হয়তো কেনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি জড়িত থাকতে পারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.