যুক্তরাষ্ট্রের সিলভারগেট এবং সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতন অ্যান্টার্কটিকায় হিমবাহ থেকে সরে যাওয়া হিমশৈলের মতো। এখানে উষ্ণায়নের সঙ্গে তুলনা করা যায় মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে সুদের হারের ক্রমাগত বৃদ্ধিকে। আমানতকারীদের আমানতের ওপর ব্যাংক থেকে সামান্য মুনাফা দেওয়া হচ্ছে; মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে দেওয়া হয় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ফলে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে ফেলার ঝোঁক তৈরি হয়েছে। ২০০৮ সালে ওবামা প্রশাসন যেভাবে ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট বা আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল, তার ফল হিসেবে এখন ব্যাংকগুলোর ভাঙন ত্বরান্বিত হচ্ছে। ১৫ বছরে ব্যাংকে বন্ধক রাখার প্যাকেজ পরিমাণগত দিক থেকে সহজীকরণের ফলে মূল্য ফের স্ফীত হয়েছে এবং এর সঙ্গে বেড়েছে আবাসন মূল্য, স্টক ও বন্ড মূল্য।
ওই সহজীকরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা ফেডারেল রিজার্ভ ৯ ট্রিলিয়ন ডলার (বাজেট ঘাটতির অংশ হিসাবে গণনা করা হয় না) খরচ করার ফলে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বন্ধকে সুদের হার বাড়ার কারণে ঋণ করে বাড়ির মালিক হওয়ার খরচ বেড়েছে। ব্যাংকে আমানতের ওপর সুদের হার ১ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়ায় মার্কিন অর্থনীতির ইতিহাসে বন্ড-মার্কেট সবচেয়ে বড় আকার ধারণ করেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে ব্যাপক মেরূকরণ হচ্ছে।
কিন্তু ব্যাংক সুদের হার অবশেষে বেড়ে গেলে এর ফল কী হতে পারে? এর অবধারিত ফল হলো এরই মধ্যে ইস্যুকৃত বন্ডের মূল্য হ্রাস পাওয়া। একই সঙ্গে মর্টগেজ ও অন্যান্য সিকিউরিটির মূল্যও কমে যায়, যা ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের বিপরীতে ধরে রাখে; যেগুলো ব্যাংকের সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ‘মুদ্রাস্ফীতি’র বিরুদ্ধে ফেডারেল রিজার্ভের লড়াইয়ের কারণেই এটি ঘটছে। ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থান ও মজুরি স্তরের বিরোধে সংকট তৈরি হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের সম্পদ তাদের আমানতের চেয়ে কমে যাওয়ার হুমকি তৈরি হয় এবং তারা সম্পদ হারায়। ২০০৮ সালেও এমন হুমকি তৈরি হয়।
আশির দশকে এসঅ্যান্ডএলএস তথা সঞ্চয় ও ঋণদান প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এটি আরও ব্যাপকভাবে ঘটেছিল, যা তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এই ‘আর্থিক মধ্যস্থতাকারী’ ব্যাংকগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মতো ঋণ দেয় না। তারা স্থায়ী সুদের হারে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধকি আকারে টাকা ধার দেয় এবং সেটা প্রায়ই ৩০ বছরের জন্য। কিন্তু আশির দশকে সুদের হারে ভলকার নীতি তথা হেজ ফান্ডের মতো তহবিলের ব্যাংকের বিনিয়োগ বন্ধের কারণে সুদের হারের সামগ্রিক স্তর এসঅ্যান্ডএলএস ও ব্যাংকগুলো যে সুদের হার গ্রহণ করছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল।
আমানতকারীরা অন্য কোথাও অনেক বেশি লাভ পাওয়ার জন্য তাদের অর্থ উত্তোলন করতে শুরু করে। কারণ, এসঅ্যান্ডএলএস ও ব্যাংকগুলো তাদের আমানতকারীদের উচ্চ হারে মুনাফা দিতে পারে না। তাই স্বল্পমেয়াদি দায় ও দীর্ঘমেয়াদি সুদের হারের মধ্যে গোলমালের কারণে তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। এসঅ্যান্ডএলএসগুলো আমানতকারীদের কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদি আমানত নেয়, কিন্তু মূল্য হারানো দীর্ঘমেয়াদি সম্পদে আটকে পড়ে। অবশ্য এসঅ্যান্ডএলএসগুলোর নেওয়া মর্টগেজ বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় অনেক দীর্ঘমেয়াদি ছিল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান সুদের হারের প্রভাব তাদের ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়ে। ঠিক যেমন ওবামার আমলে পরিমাণগত সহজলভ্যতার কারণ ছিল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা। কিন্তু এর বিপরীত প্রভাব দেখা দেয় এবং ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়ে।
যে কোনো ব্যাংকের আমানতের দায় থেকে তার সম্পদের মূল্যমান বেশি রাখার সমস্যা আছে। যখন ফেডারেল রিজার্ভ বন্ডের দাম কমানোর জন্য সুদের হার যথেষ্ট পরিমাণে বাড়ায়, তখন ব্যাংকিং সিস্টেমে সম্পদের কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়। এ কারণেই ওই সহজীকরণ পরিকল্পনায় সমস্যা দেখা দেয়। ফেডারেল রিজার্ভ অবশ্যই এই সহজাত সমস্যাটি স্বীকার করে। এই কারণেই তারা এতদিন ধরে সুদের হার বাড়ানোর বিষয়টি এড়িয়ে গেছে এবং যতক্ষণ না মজুরি কম থাকা পর্যন্ত তারা অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু যখন মজুরি পুনরুদ্ধার হতে শুরু করে তখন ফেডারেল রিজার্ভ শ্রমের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক শ্রেণিযুদ্ধের মতো লড়াই করতে পারেনি। এর ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়।
সিলভারগেট প্রথম বন্ধ হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সির ওপর ভর করে এটি ব্যবসা করতে চেয়েছিল। সিলভারগেটের ব্যর্থতা ক্রিপ্টোকারেন্সি সংক্রান্ত সে বিভ্রম স্পষ্ট করেছে। সবার ধারণা ছিল, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ‘ফিয়াট মুদ্রা’ বা হুকুমি মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ক্রিপ্টো কাজ করে। কিন্তু ক্রিপ্টো তহবিল তাদের মুদ্রা কেনাকাটা করতে কি বিনিয়োগ ফিরিয়ে দিতে পারে? বিশেষ করে যদি তা ব্যাংক আমানত এবং সরকারি বা ব্যক্তিগত স্টকের বন্ড না হয়?
আইটি স্টার্টআপগুলোকে বিশেষায়িত ঋণ দেওয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধের প্রধান কারণ। নিউ রিপাবলিক ব্যাংকও এমন সংকটে পড়েছিল এবং এটি বিশেষায়িত ব্যাংক, যেটি সানফ্রান্সিসকো এবং উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া এলাকায় ধনী আমানতকারীদের ঋণ প্রদান করেছে। কিন্তু গত সপ্তাহে একটি ব্যাংকের কথা বলা হচ্ছিল। যেখানে আমানতকারীরা তাদের আমানত উঠিয়ে নিচ্ছিল। বন্ডের দাম কমে যাওয়ায় বাজার পড়ে গিয়েছিল যখন ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান বলেছিলেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে সুদের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছেন।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংককে সম্ভবত এখন একটি বৃহত্তর ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করানো হবে। কিন্তু এর মাধ্যমে পুরো আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতা চাপা দেওয়া হচ্ছে। রয়টার্স শুক্রবার রিপোর্ট করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকগুলোর রাখা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এটি কমই আশ্চর্যজনক। কারণ ব্যাংকগুলো রেকর্ড সুদের স্প্রেড ভোগ করছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, সচ্ছল বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক থেকে সরে যাচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, কেন ফেড কেবল সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোকে অর্থ দিচ্ছে না? উত্তর হলো, আর্থিক সম্পদের জন্য কম দাম নতুন স্বাভাবিক ঘটনা। নেতিবাচক ইক্যুইটিসহ ব্যাংকগুলোর জন্য ১৫ বছরের শূন্য সুদের হার নীতি পুনরুদ্ধার করার জন্য সুদের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস না করে কীভাবে সচ্ছলতা সমাধান করা যেতে পারে? গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার অস্থিরতা বেড়েছে। প্রতিটি সার্থক অনুমানের একটি নেতিবাচক দিক রয়েছ। যখন ট্রিলিয়ন ডলারের ওপর বাজি ধরা হয়, তখন কিছু ব্যাংক ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়, যা সহজেই ব্যাংকের সম্পূর্ণ আমানত নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। বন্ডের দাম পড়ে যাওয়ার পর এ পর্যন্ত স্টক মার্কেট অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে। আমার অনুমান হলো, আমরা এখন ২০০৮-২০১৫ সালের সেই কাল্পনিক পুঁজির খেলা দেখতে পাব।
মাইকেল হাডসন: আমেরিকান অর্থনীতিবিদ; কাউন্টারপাঞ্চ থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফজুর রহমান মানিক