রাজধানীর খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ ১৫ মার্চ পর্যন্ত আকস্মিক ছুটি ঘোষণা করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। কোনো কারণ ছাড়াই এভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তবে অধ্যক্ষ দাবিদার ফরহাদ হোসেনকে স্বপদে বহাল রাখার জন্য হাইকোর্টে রিট করেছেন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রবিধানমালা অনুসারে, পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি প্রতিষ্ঠানে কোনো ছুটি ঘোষণা করতে পারেন না। এই এখতিয়ার কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠান প্রধানের। প্রধান শিক্ষক প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, অথবা বিশেষ পরিস্থিতিতে, জরুরি ও যৌক্তিক কারণে বছরে সর্বোচ্চ তিন দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে পারেন। এখতিয়ার-বহির্ভূতভাবে প্রতিষ্ঠানে টানা ৫ দিন ছুটি ঘোষণা করায় প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি দেলোয়ার হোসেনকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। বোর্ডের ওয়েবসাইটেও এ নোটিশ পোস্ট করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘মনিপুর স্কুলের ঘটনায় আমরা বিস্মিত। প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করার এখতিয়ার কমিটির সভাপতি কোথায় পেলেন? ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর টানা ৫ দিন পাঠদান বন্ধ। এর দায় কে নেবে?
বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নির্দেশনা অনুসারে প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জাকির হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া এবং বিধিবহির্ভূতভাবে ছুটি ঘোষণা করায় পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। অধ্যাপক তপন কুমার বলেন, সরকারি নির্দেশনা না মানায় কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে। এরই একটি প্রক্রিয়া এই কারণ দর্শাও নোটিশ।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে দেলোয়ার হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। বুধবার প্রতিষ্ঠানের অ্যাডহক কমিটির এই সভাপতি ১৫ মার্চ পর্যন্ত পাঠদানসহ সব দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন।
এদিকে বন্ধ ক্যাম্পাসে গতকাল বৃহস্পতিবার মাউশি নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন শিক্ষক-কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন। মনিপুরে প্রতিষ্ঠানের মূল বালিকা শাখায় এ সভা আহ্বান করলেও বিদ্যালয়ের কেয়ারটেকার প্রধান ফটকে তালা মেরে পালিয়ে যান। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শিক্ষক-কর্মচারীরা তালা না ভেঙে প্রতিষ্ঠানের ৬০ ফিট ক্যাম্পাসে গিয়ে সভা করেন। সেখানে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে ১২ মার্চ থেকে প্রতিষ্ঠানের পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সভায় বিদ্যালয়ের সব ক্যাম্পাসের ১২ জন সহকারী প্রধান শিক্ষক যোগ দেন। তবে এ সময় অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোন এলে তাঁরা সেখান থেকে বেরিয়ে ব্রাঞ্চ-২ ক্যাম্পাসে চলে যান।
গতকাল মনিপুর বিদ্যালয়ের ৬০ ফিট ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে, গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড়। শ্রেণি ও অফিস কার্যক্রম ছিল বন্ধ। কিছু উৎসুক অভিভাবক ক্যাম্পাসে আসেন। তাঁরা গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, আমরা সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই অচলাবস্থার অবসান চাই। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির বলেন, শিক্ষক- কর্মচারীরা সবাই তাঁর প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা রোববার থেকে পাঠদান যথারীতি চালিয়ে যাবেন।
আদালতে রিট: জাকিরকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ সংবলিত মাউশির আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন পরিচালনা কমিটির সভাপতি।
গতকাল বিচারপতি খসরুজ্জামান ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের বেঞ্চে রিটের শুনানি হয়। রিটকারীর আইনজীবী দাবি করেন, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় একটি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া এটির কলেজ শাখা থাকায় অধ্যক্ষ হবেন প্রতিষ্ঠান প্রধান, প্রধান শিক্ষক নন। তাছা ড়াজাকির হোসেন বরখাস্ত শিক্ষক। তাই তাঁকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়াও আইনানুগ হয়নি।
বিবাদীদের আইনজীবী বলেন, সরকারি নথিপত্রে এ প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত। জাকিরকে যখন বরখাস্ত দেখানো হয়েছে তখন কমিটির মেয়াদ ছিল না। তাই এই বরখাস্ত আদেশই অবৈধ। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখার পাঠদানের অনুমতি ও সরকারি স্বীকৃতি নেই। এমপিও নেই। তাই সরকারি দৃষ্টিতে এটির প্রতিষ্ঠান প্রধান হবেন প্রধান শিক্ষক। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি শেষে কোনো আদেশ না দিয়ে আগামী সোমবার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।
জানা গেছে, ২০২০ সালে মাউশি তদন্ত শেষে বলেছিল অধ্যক্ষ পদে ফরহাদের নিয়োগ অবৈধ। এরপর ঢাকা বোর্ডের আরেক তদন্তেও বেরিয়ে আসে অধ্যক্ষ পদে তাঁর চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধিও আইনসম্মতভাবে হয়নি।
এ অবস্থায় আদালতের নির্দেশে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক জাকিরকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয় মাউশি। পরিচালনা কমিটির সভাপতির কাছে লেখা পত্রে তিন কর্মদিবসের মধ্যে এই ব্যবস্থা নিতে বলেছিল মাউশি। তবে পরিচালনা কমিটি তাতে কর্ণপাত করেনি।
বিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, এ প্রতিষ্ঠানটি মূলত শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে। তিনি নিজেই এক সময় এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সংসদ সদস্যরা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদ থেকে বাদ গেলে তিনি তাঁর কন্যাকে সভাপতির দায়িত্ব দেন। পরে তাঁর কন্যা পদত্যাগ করলে কামাল আহমেদ মজুমদার তাঁর অনুগত দলীয় নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেলোয়ারকে সভাপতি করেন।