পারিবারিক বাধা তো ছিলই। সঙ্গে ছিল আর্থিক সমস্যা। ইজিবাইক চালিয়ে যতটুকু আয় করেন বাবা, তা দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। পারিবারিক অসচ্ছলতা দেখে বড় হওয়া সুমনা রায়ের স্বপ্নগুলোও থমকে যেতে বসেছিল। দিনাজপুর সদর কৃষাণ বাজার থেকে মডার্ন বডি বিল্ডিং ক্লাবে গিয়ে ভারোত্তোলনের প্র্যাকটিস করতে যে টাকা লাগত, সেটা বাবার পক্ষে দেওয়া কষ্টসাধ্য ছিল।
সাইকেল চালিয়ে গন্তব্যে যেতে যেখানে লাগত প্রায় ৪৫ মিনিটের মতো, সেখানে অনেক সময় অনুশীলনে যেতে সুমনার ভরসা ছিল নিজের দুটি পা। প্রায় আড়াই ঘণ্টা হেঁটে বাড়ি থেকে ক্লাবে যেতেন এ ভারোত্তোলক। সোমবার শেখ জামাল দ্বিতীয় যুব গেমসে তরুণী বিভাগের ৪৫ কেজি ওজন শ্রেণিতে ১১৫ কেজি ভারোত্তোলন করে স্বর্ণ পদক জিতেছেন রংপুর বিভাগের হয়ে। গলায় স্বর্ণের পদক ঝুলিয়ে সুমনা ভেসে যান বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে।
১৩ বছর বয়সে যে স্বপ্ন আর লক্ষ্য নিয়ে ভারোত্তোলনে নাম লিখিয়েছেন দুই বছরের মধ্যে স্বর্ণ জিতে নতুনের জয়গান গাইছেন তিনি। আর এই একটি সোনালি পদকই ভুলিয়ে দিয়েছে সুমনার সব দুঃখ, ‘পরিবার থেকে অনেক বাধা পেয়েছি। এই পর্যায়ে আসতে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক বাধাবিপত্তি। স্বর্ণ জয়ের পর ভুলে গেছি সব কষ্ট।’
ভারোত্তোলকের ম্যাটে উঠতে গিয়েও সুমনাকে পড়তে হয়েছে বাধার সামনে। গত ছয় মাস ধরে বাংলাদেশ আর্মিতে অনুশীলন করেছেন। সার্ভিসেস এ সংস্থায় কোনো চাকরি করেন না কিংবা কোনো ভাতাও পান না তিনি। থাকা-খাওয়া আর প্র্যাকটিসের সুবিধা বাংলাদেশ আর্মি থেকে পাচ্ছেন সুমনা। যুব গেমসে কোনো সার্ভিসেস দলের অ্যাথলেটের খেলার অনুমিত নেই। এই জন্য তাঁকে খেলানো নিয়ে আপত্তি তোলে অনেকে। যেহেতু তিনি আর্মিতে চাকরি করেন না এবং ভাতাও পান না, তাই তাঁর খেলায় কোনো বাধা নেই বলে ফেডারেশনের কর্তারা সিদ্ধান্ত নেন।
সেই সিদ্ধান্তটি যে জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে দিনাজপুরে শহীদ জমির উদ্দীন গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এ শিক্ষার্থীর, ‘খুবই ভালো লাগছে। যেখানে আমাকে খেলতে দিচ্ছিল না। আমার অভিভাবক যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধের পর আমি এখানে খেলতে পেরেছি। এখন আমি গোল্ড মেডেল পাইছি।’
২০১০ সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জেতা হামিদুল, ২০১৯ এসএ গেমসে সেরা হওয়া জিয়ারুলের হাত ধরেই ভারোত্তোলকে আসা সুমনা রায়ের। আর্মি স্টেডিয়ামের মাল্টিপারপাস শেডে সাজানো মঞ্চ দেখে সুমনার মনে নতুন স্বপ্ন জেগেছে। চোখ ধাঁধানো স্টেজ এবং বড় তারকাদের দেখে যেন স্বপ্নের ঘোরে তিনি। ভারোত্তোলনে বাংলাদেশের অন্যতম তারকা মাবিয়া আক্তার সীমান্তের সামনে ভার তুলেছেন।
স্বর্ণ জেতার পর সীমান্তের কাছ থেকে শুভেচ্ছা পেয়েছেন। এবার যুব গেমসে স্বর্ণ জেতার পর তাঁর বিশ্বাস মাবিয়াকেও ছাড়িয়ে যেতে পারবেন, ‘আমি মাবিয়া আপুর চেয়েও বড় কিছু হতে চাই। আমি এমন কিছু হতে চাই যেন আমাকে দেশ, আমাদের খেলার জগতের সবাই অনুকরণ করে। আমাকে দেখে যেন আরও অনেকে খেলায় আসে। এবং নিজের জীবনেক আরও অনেক উন্নত করতে পারি।’