বিপুল বিনিয়োগের সড়ক কতটা মানসম্মত

0
226
দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি পিচঢালা সড়ক। নিম্নমানের কাজে কয়েক মাসেই বেহাল হয়েছে পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ-বেতাগী-কচুয়া সড়ক। ছবিটি সম্প্রতি তোলা

নতুন সড়ক ২০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকবে ধরে নিয়ে বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মেরামতের দরকার পড়ে। এমনকি কিছু সড়ক দ্রুতই বেহাল হয়ে যাচ্ছে। এত বিনিয়োগের পরও দেশের সড়কের অবস্থা কেন খারাপ—এই প্রশ্ন আসতেই পারে। আসলে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, যথাযথ উপকরণ না দেওয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণব্যবস্থাই সড়ক টেকসই না হওয়ার পেছনে মূল কারণ। অথচ মানসম্মত উপকরণ নিশ্চিত করা এবং নির্মাণের পর তা যাচাই করার জন্য সওজের গবেষণাগার আছে। গবেষণাগার রয়েছে সড়ক নির্মাণের দায়িত্বে থাকা আরেক সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরেরও (এলজিইডি)। কিন্তু এসব গবেষণাগার নামেই আছে। সড়ক নির্মাণের পর তা যথাযথভাবে হয়েছে কি না, তা আর দেখা হয় না।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণয়ন করা ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১’ অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব মহাসড়ক ছয় লেন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আট লেনে উন্নীত করার কথা। মহাসড়কগুলোকে ‘স্মার্ট হাইওয়ে’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। এ জন্য সারা দেশের নদী-খাল-বিলের দুই পাড়ের সংযোগ ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অনগ্রসর অঞ্চলগুলোকে যোগাযোগ কাঠামোতে আনার চেষ্টা চলছে। কিন্তু দেশে এখনো পর্যন্ত সড়ক–মহাসড়ককে টেকসই করতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি।

দেশে সড়ক ও সেতু নির্মাণব্যবস্থা পুরোপুরি ঠিকাদারের ওপর নির্ভরশীল। তবে ঠিকাদার কীভাবে কাজটি করবেন, তা আগেই ঠিক করে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট কোনো কাজে কোন মানের, কী কী পণ্য, কী পরিমাণে তা ব্যবহার করতে হবে, সেগুলোর একটা বিবরণ থাকে দরপত্রে। সে অনুযায়ী, ঠিকাদারের নির্দিষ্ট দরে কাজ সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু ঠিকাদারের বিরুদ্ধে সড়ক নির্মাণে সঠিক ও মানসম্মত উপকরণ ব্যবহার না করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

সড়ক গবেষণাগারের মূল কাজ হচ্ছে, কাজ শুরুর আগে একবার নির্মাণ উপকরণ বা পণ্যের মান যাচাই করা। এরপর চুক্তি অনুসারে মানসম্মত ও সঠিক পরিমাণে উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করা। কিন্তু গবেষণাগারে এখন
আর এই কাজ হয় না। শুধু কাজ পাওয়ার পর ঠিকাদার নির্মাণ উপকরণের নমুনা পরীক্ষা করে নেন। অনেক সময় সক্ষমতা না থাকায় সওজের গবেষণাগারে সব পণ্যের পরীক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কিংবা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গবেষণাগার থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনা হয়। এমনকি অনেক বড় প্রকল্পের মালামাল পরীক্ষা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ল্যাবে। ফলে গবেষণাগারের কাজ একেবারেই কমে গেছে। সড়ক নির্মাণের পর মান যাচাই করার সুযোগ থাকলেও সেটা হচ্ছে না। ফলে দ্রুত সড়ক বেহাল হয়ে পড়ে।

সওজের কেন্দ্রীয় গবেষণাগারটি রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগে। প্রায় ৪১ একর জায়গাজুড়ে ১৯৬৫ সালে গড়ে তোলা হয় এই গবেষণাগার। লক্ষ্য ছিল সওজ ছাড়াও সারা দেশের সড়কের মান নিয়ন্ত্রণ করবে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এই গবেষণাগারের অর্জন কী? ৫৮ বছরের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশ তো দূরের কথা, নিজের প্রতিষ্ঠান সওজের সড়কেরই মান নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেন্দ্রীয় গবেষণাগার ছাড়াও মাঠপর্যায়ে নয়টি গবেষণাগার আছে। এসব গবেষণাগারে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের বেশির ভাগই মনে করেন এটি হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় বা ডাম্পিং পোস্ট। ফলে পদায়ন হওয়ার পর অন্যত্র বদলির অপেক্ষায় থাকেন তাঁরা।

অবশ্য গবেষণা বা মান যাচাইয়ের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দও নেই। সওজের হিসাবে, মিরপুরসহ সারা দেশের ল্যাবরেটরির কমকর্তাদের বেতন–ভাতার বাইরে গবেষণা বরাদ্দ সামান্য। ২০১৬–১৭ থেকে ২০২১–২২ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে গবেষণা ও উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি টাকার কম। এর মধ্যে ২০১৬–১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। পরের দুই বছর যথাক্রমে দেড় কোটি ও এক কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৮–১৯ এবং ২০১৯–২০ এই দুই অর্থবছরে পরপর পাঁচ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেয় সরকার। করোনার সময় ২০২১–২২ অর্থবছরে বরাদ্দ কমে দাঁড়ায় ৫০ লাখ টাকা।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে গিয়ে দেখা গেল, ১৪ একর জমির ওপর পুরোনো বেশ কিছু ভবন, অফিস ও গুদাম, গ্যারেজ ও পুরোনো যন্ত্রপাতিসহ গবেষণাগারটির অবস্থান। ১৬ একরের মতো জায়গা ব্যবহৃত হচ্ছে সওজের আবাসন হিসেবে। প্রায় ১১ একরের মতো জায়গা আছে পরীক্ষামূলক সড়ক নির্মাণের জন্য। কিন্তু তার ব্যবহার খুব একটা হয় না। একটি অংশে গড়ে উঠেছে র‌্যাব-৪–এর কার্যালয়।

২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম পৃথিবীর ১৩৪টি দেশের সড়ক নিয়ে জরিপ করে। এতে বেহাল সড়কের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে ১১৩ নম্বরে। বাংলাদেশের পেছনে একমাত্র দেশ নেপাল। পার্বত্য দেশ হওয়ায় প্রকৃতিগতভাবেই নেপালের সড়ক কম। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় সে দেশে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণও কঠিন। তবে শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। সড়ক অবকাঠামোতে এশিয়ায় শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর।

সড়কের মান বা অবস্থার ওপর নির্ভর করে যানবাহনের গতিবেগ। ভালো মানের সড়কে যানবাহনের গতিবেগও বেশি। সড়কে গতি কম থাকার কারণ হচ্ছে বেহাল সড়ক, বাঁক বেশি থাকা, চওড়া কম হওয়া ইত্যাদি। সড়কের গুণমান ও গড় গতিবেগ বিষয়ে গত বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৬২টি দেশের সড়ক নিয়ে তৈরি ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের সড়কে গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৪১ কিলোমিটার। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু পূর্ব তিমুর, নেপাল ও ভুটান। এর মধ্যে পূর্ব তিমুর দ্বীপরাষ্ট্র। আর নেপাল ও ভুটান পাহাড়ি পথ। সবচেয়ে বেশি গড় গতি যুক্তরাষ্ট্রে, ঘণ্টায় ১০৭ কিলোমিটার। এরপরই আছে পর্তুগাল, সৌদি আরব, কানাডা, ফ্রান্স।

এমনকি সওজের নিজেদের সমীক্ষাতেও দেশের সড়ক–মহাসড়কের দুরবস্থার কথা উঠে এসেছে। হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট মডেল (এইচডিএম-৪) সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রতিবছর সড়কের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সওজ।

সওজের এইচডিএম সার্কেল গত বছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে গাড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে যন্ত্রের সাহায্যে সড়কের অবস্থা নিয়ে সমীক্ষা করে। এরপর এপ্রিলে সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে।

ওই সমীক্ষায় সওজের সড়কগুলোকে পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভালো ও চলনসই হচ্ছে আদর্শ। আর জীর্ণশীর্ণ, খারাপ ও খুবই খারাপ—এই তিন ধরনের সড়ক মেরামত প্রয়োজন।

সমীক্ষা অনুসারে, সারা দেশে জীর্ণশীর্ণ, খারাপ ও খুবই খারাপ সড়কের পরিমাণ ২ হাজার ৭৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে খুবই খারাপ সড়কের পরিমাণ ৪৫৭ কিলোমিটার, যা মোট সড়কের ২ দশমিক ২৮ শতাংশ। অথচ ২০১২-১৩ অর্থবছরে খুব খারাপ সড়কের পরিমাণ ছিল ২৯৬ কিলোমিটার, যা মোট সড়কের ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক দশকে খুব খারাপ সড়কের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ এ সময় লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে।

এই সমীক্ষায় সওজের অধীনে থাকা কাঁচা সড়ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া ও সম্প্রসারণ বা সংস্কারের কাজ চলা সড়ক রাখা হয়নি। ফলে বলা যায় খারাপ সড়কের পরিমাণ আরও বেশি।

অবশ্য সওজের কর্মকর্তারা দ্রুত সড়ক খারাপ হওয়ার পেছনে কতগুলো কারণ বলে থাকেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. বৃষ্টি-বর্ষায় সড়ক ডুবে যাওয়া। ২. অত্যধিক ভারবাহী যানবাহনের চলাচল। ৩. রক্ষণাবেক্ষণে অপ্রতুল বরাদ্দ।

বর্ষায় পিচের রাস্তা বেশি ক্ষয় হয়, এটা সত্য। কিন্তু বৃষ্টির কারণেই সব সড়ক নষ্ট হয়ে যায়, এটা বলা কঠিন। কারণ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার প্রায় সব দেশই বৃষ্টিবহুল। এসব দেশে সড়ক তাহলে কীভাবে ঠিক রাখা হয়, এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে। এখানেই গবেষণা এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার জড়িয়ে আছে। এখানেই বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণের প্রধান সংস্থা সওজ পিছিয়ে আছে।  

ইংরেজ শাসনের আগে এই অঞ্চলের মূল সড়কব্যবস্থা ছিল সোনারগাঁ সড়ক বা গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। ব্রিটিশ বাংলায় ট্রেন চালু হয় ১৮৬২ সালে। নদীপথের বাইরে মাঝারি দূরত্ব ও দীর্ঘ যাত্রায় একমাত্র বাহন ছিল রেলওয়ে। ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মাধ্যমে রেলপথের গুরুত্ব আরও বাড়ে। কিন্তু দেড় শ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে রেলপথ এগোতে পারেনি। এখন দেশে রেলপথের পরিমাণ মাত্র তিন হাজার কিলোমিটার, যা দেশের ৪৩টি জেলাকে যুক্ত করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে এলজিইডির পাকা সড়কের পরিমাণ দেড় লাখ কিলোমিটার। আর সওজের পাকা সড়ক আছে সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার।

এর মধ্যে গত ৭ নভেম্বর সারা দেশে এক দিনে ‘শত সেতু’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সওজ অধিদপ্তরের অধীনে নির্মিত এসব সেতু দেশের ৭টি বিভাগের ২৫টি জেলায় হয়েছে। সব কটি সেতু একসঙ্গে জোড়া দিলে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে।

শত সেতুর পর সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর দেশের ১০০ সড়কের অংশবিশেষ নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। এসব উন্নয়ন করা সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২ হাজার ২১ কিলোমিটার। এর বেশির ভাগই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক।

সওজের তথ্য অনুসারে, দেশের ৮টি বিভাগের ৫০টি জেলায় বিস্তৃত এসব সড়ক। মোট ৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে প্রায় ১৪ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে। এই ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থের জোগান দিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের সংসদ সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন অল্প। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৬২ শতাংশ। এই ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ আবার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ঠিকাদারিতে যুক্ত। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে ঠিকাদার জনপ্রতিনিধির সংখ্যা আরও বেশি। অর্থাৎ সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ, রাজনীতিকেরা ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ কেউ বড় দেশি-বিদেশি ঠিকাদারের স্থানীয়–কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। এই প্রভাবশালীদের কাছ থেকে মানসম্মত কাজ আদায় করার জন্য যে শক্তিশালী গবেষণাগার, ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, তা দেশে নেই। ফলে সড়ক টেকসই হচ্ছে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.