মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবিত ও বিকাশে গবেষণা অত্যাবশ্যক: প্রধানমন্ত্রী

0
184
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবিত ও বিকাশে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আমি সবসময় গবেষণার উপর জোর দেই। কারণ, গবেষণা ছাড়া কোনো কিছুর সমৃদ্ধি সম্ভব নয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২৩ উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। খবর বাসসের

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে বিদ্যমান সব ভাষা সংরক্ষণের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের। আমি মনে করি, সারাবিশ্বে বিদ্যমান সব ভাষাকে সংরক্ষণ, এর ওপর গবেষণা করা এবং এগুলোর ইতিহাস জানা এই ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব।

তিনি বলেন, আমরা চাই বিশ্বের বিপন্ন ভাষাগুলো এখানে সংরক্ষণ এবং তারওপর গবেষণা করা হোক। এই গবেষণার ওপরই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ভাষা সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অনেক অবদান রাখতে পারে। এখানে যে কেউ যে কোনো ভাষা শিখতে চাইলেও আসতে পারবেন। ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।

পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বাংলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা আর উর্দুকে মুসলমানের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার মতো মন মানসিকতার অধিকারীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এধরনের মানসিক দৈন্যতায় যারা ভোগেন তাদের জন্যই ভাষার ইতিহাস ও উৎপত্তিস্থল জানা একান্তভাবে দরকার।

এ পর্যন্ত আন্তজাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বিশ্বের ১৬টি ভাষায় বহুভাষী পকেট অভিধান করার ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি মাতৃভাষা পিডিয়া তৈরির প্রকল্প গ্রহণ এবং ভাষা-সাহিত্যকর্ম, বাংলা অনুবাদ ও বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন শীর্ষক একটি প্রামান্য চিত্র বিভিন্ন ভাষায় করার উদ্যোগ নেয়ায় তিনি সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।

অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ হাসিনা ভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৩ জন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক’ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক পদক’ তুলে দেন।

হাবিবুর রহমান ও রঞ্জিত সিংহকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মহেন্দ্র কুমার মিশ্র ও মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সোসাইটির পক্ষে এর সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম পদক গ্রহণ করেন।

শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের অফিসার ইনচার্জ সুসান মারি ভাইজ।

রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার ‘বহুভাষিক বিশ্বে বহুভাষিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’র ওপর আলোকপাত করে একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। এর আগে জাতীয় সঙ্গীত এবং অমর একুশের সঙ্গীত- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি,’ পরিবেশিত হয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, জাপান, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের শিশুরা প্রধানমন্ত্রীকে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শুভেচ্ছা জানায়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ দেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার এবং সেজন্য ফান্ড লাগলে আমি তার ব্যবস্থা করে দেব। কারণ আমি সবসময় গবেষণায় বেশি জোর দেই। গবেষণা ছাড়া কোনো বিষয়েই উৎকষর্তা সাধন করা যায় না।

তিনি বলেন, আজ আমরা খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি তা গবেষণারই ফসল এবং ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর আবার সরকার গঠন করেই গবেষণায় গুরুত্ব আরোপ করে এবং বরাদ্দ দেয়। প্রথমে ১২ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বাজেটে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়। তিনি এ সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যখাতে অধিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।

যে সব এলাকায় স্কুল নাই তার সরকার সেসব এলাকায় স্কুল, প্রতিটি উপজেলায় সরকারি কলেজ এবং প্রতিটি জেলায় বিষয় ভিত্তিক বহুমুখী বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি থেকে আরও কয়েকটি করে দেয়া হয়েছে। কোন অঞ্চলে কী ধরনের মানুষ জন এবং তাদের কী ধরনের শিক্ষার দরকার তার ওপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষা এবং গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে ইংরেজি ভাষাটা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমনভাবে চলে গেছে যে শিক্ষা-দীক্ষাসহ সবকিছুতে এই ভাষাই পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে গিয়েছে। কিন্ত সেই সাথে নিজের ভাষা শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। নিজের ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি অন্য যে কোনো একটি বা দুটি ভাষা আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখতে পারে। আর এখন ডিজিটাল যুগে ডিজিটালি ও শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

২০০১ সালে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করে নির্মাণ কাজ শুরু করলেও পরবর্তী বিএনপি-জামাত সরকার সেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে আবারো সরকারে এসে নিজের মনের মতো করে ইনস্টিটিউটটি গড়ে তোলেন বলেও জানান তিনি।

বাঙালি জাতি রক্ত দিয়ে মা ডাকার অধিকার পেয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সংস্কৃতির ওপর অনেক আঘাত আনা হয়। আমাদের ভাষা পাল্টে দিয়ে অন্য ভাষা তুলে ধরা হয়। তখন আজকের এই দিনে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়ে মা ডাকার অধিকার পেয়েছিল।

ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা তুলে ধরে শেখ হাসিনা  বলেন, দেশের মানুষের কাজের সুবিধার জন্য আমরা ৯টি ভাষার একটি অ্যাপ করেছি। ডিজিটাল সিস্টেমে যে কেউ যেন ভাষা শিখতে পারে, আমরা সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

শিশুরা তাড়াতাড়ি ভাষা শিখতে পারে। তারা একসঙ্গে দুই-তিনটা ভাষা দ্রুত শিখে নেয়। তবে কোনটা ধারণ করবে সেটা আসে পরে। মাতৃভাষায় শিক্ষা হলে সবকিছু জানা, বোঝা ও উপলব্ধি প্রকাশ করার উপকার অনেক বেশি।

এখন ফ্রিল্যান্সিংয়ের যুগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা এর মাধ্যমে টাকা উপার্জন করতে পারছে। আমরা তাদের লার্নিং এবং আর্নিংয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তারা এখন একেবারে ইউনিয়নে বসে বিদেশে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারছে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করাচিতে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি শিক্ষা সম্মেলন করা হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা হবে। এই খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। তখন এভাবে প্রতিবাদ শুরু হয়। ভাষার জন্য আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম অব্যাহত ছিল।

তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস উপস্থাপ করে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও বারবার কারাবরণ এবং কারাগার থেকেই ৫২’র ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষার সংগ্রামকে চূড়ান্ত রূপদানের বিভিন্ন খণ্ড চিত্রও তুলে ধরেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.