ডিপ্লোমা ছাড়া পদোন্নতি বন্ধ, যোগ্যতা হারাতে পারেন হাজারো ব্যাংকার

0
246
ব্যাংকিং , ছবি: রয়টার্স

এই দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এক নতুন নির্দেশনার কারণে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের চাকরিতে সিনিয়র অফিসার বা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অথবা সমতুল্য পদের ওপরে যেকোনো পদে পদোন্নতি পেতে হলে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার দুই পর্বেই পাস করতে হবে। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাস ছাড়া কোনো ব্যাংকার পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল বুধবার এই নির্দেশনার মাধ্যমে উচ্চতর পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ডিপ্লোমাকে বাধ্যতামূলক করেছে, যা দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে ২০২৪ সাল থেকে।

এর আগে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ডিপ্লোমাকে গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও এবার তা বাধ্যতামূলক করল বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও ক্ষেত্রে একই নিয়ম চালু করা হয়েছে।

ফলে শফিকুর রহমানের মতো হাজারো ব্যাংকার পদোন্নতির যোগ্যতা হারাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শফিকুর রহমান সম্ভবত ভাগ্যবান হতে পারেন, কারণ তিনি বাণিজ্য অনুষদে পড়াশোনা করে ব্যাংকে যোগ দিয়েছেন। ফলে হয়তো একদিন তাঁর পক্ষে ডিপ্লোমা পাস করাও সম্ভব হবে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং পেশায় যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁদের বড় অংশই অন্যান্য অনুষদের শিক্ষার্থী। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা তাঁদের পেশাগত জীবনকে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে।

স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকারদের মধ্য থেকেই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার উদ্দেশ্য নিয়ে। ফকির আকতারুল আলম নামের একজন ব্যাংকার তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত কিছু বাদ দিয়ে হঠাৎ ডিপ্লোমার জন্য এমন নির্দেশ জারি করতে গেল কেন, সেটা মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন’।

‘ব্যাংকিং ডিপ্লোমা ব্যাংকারদের জন্য গোদের ওপর বিষফোড়া। প্রায় ৩৫ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে আমি কখনো এর কোনো বাস্তব প্রয়োগ দেখিনি,’ লিখেছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে সিনিয়র পদে চাকরি করা এই ব্যাংকার।

ডিপ্লোমা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া দুজন ব্যাংকার জানান, ডিপ্লোমা পরীক্ষায় যে ধরনের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়, চাকরি করে তাতে উত্তীর্ণ হওয়া বেশ কঠিন। আবার উত্তরপত্র মূল্যায়ন ঠিকভাবে হয় কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকিং ডিপ্লোমার পাঠ্যক্রমে ব্যাংকিং বিষয়ের যাবতীয় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রথম পর্বে ব্যাংকিং সম্পর্কিত প্রাথমিক ও মৌলিক বিষয় পড়ানো হয়, আর দ্বিতীয় পর্বে উচ্চতর ব্যাংকিং জ্ঞান ও এ বিষয়ে দক্ষতা যাচাই করা হয়। ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (আইবিবি) পক্ষ থেকে এই দুই পর্বের ব্যাংকিং ডিপ্লোমার পরীক্ষা গ্রহণ করা ও ডিগ্রি দেওয়া হয়।

আইবিবির সাবেক মহাসচিব নওশাদ আলী চৌধুরী বলেন, আইবিবিতে প্রথমবার সব বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে পারে—এমন ব্যাংকার খুবই কম। এই হার ৩০ শতাংশও হবে না। তবে প্রথমবার দুই বিষয়ে উত্তীর্ণ হলে পরের বছরে বাকি বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়া যায়। তাই অনেকেই একে গুরুত্ব দেয় না। এ জন্য একবারে উত্তীর্ণের হার কম।

নওশাদ আলী চৌধুরীর মতে, যেসব বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেগুলো খুব জটিল নয়।
তবে ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেখা গেছে যে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ব্যাংকারদের অনেকেই ওই বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। আবার হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ব্যাংকাররা একই বিষয়ে অকৃতকার্য হচ্ছেন। এ কারণে পরীক্ষার মূল্যায়নপ্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।

আইবিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক ও ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপকের নিচে কাউকে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে দেওয়া হয় না। তাঁরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন, তা অবশ্য দেখার সুযোগ নেই।

ব্যাংকিং ডিপ্লোমায় সব মিলিয়ে ১২টি বিষয় রয়েছে। তবে ব্যাংকারদের কেউ কেউ মনে করেন, অনেক বিষয় আছে, যেগুলো বাস্তবভাবে প্রয়োগ করার সুযোগ সব কর্মকর্তার জন্য সমান নয়।

‘ফরেন এক্সচেঞ্জ, কৃষিঋণ নির্দিষ্টসংখ্যক শাখায় থাকে, ফলে সবার পক্ষে এর চর্চা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু এটা আবশ্যক,’ লিখেছেন ফকির আকতারুল আলম।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনে বলেছে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এ খাতে মৌলিক ব্যাংকিং জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির আবশ্যকতা বিবেচনায় এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। ব্যাংকিং আইন ও নিয়মাচার অনুশীলন–সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার একটি মানদণ্ড হলো ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ পরিচালিত দুই পর্বের ব্যাংকিং ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ‘ব্যাংকিং ডিপ্লোমা যদি পদোন্নতির মাপকাঠি হয়, তবে তা একধরনের বৈষম্য তৈরি করবে। কারণ, ব্যাংকাররা দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যাংক পরিচালনা করছেন। তবে তাঁদের অনেকেই ডিপ্লোমা শেষ করতে পারছেন না। আবার বিভিন্ন অনুষদ থেকে আসা ছেলেমেয়েরা ব্যাংকে ভালো করছে।’

আনিস এ খান পরামর্শ দেন যে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাস বাধ্যতামূলক করতে হলে আগে আইবিবির সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং এরপরই এমন নির্দেশনা কার্যকর করা উচিত হবে।

ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষার আয়োজন করা আইবিবির মহাসচিব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সাবেক নির্বাহী পরিচালক। এই পদে দীর্ঘদিন ধরে আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তারা। আর সচিব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.