চাইলেই কি টাকা ছাপা যায়?

0
165
ওবায়দুল্লাহ রনি

টাকার লেনদেন ও চাহিদার বিষয়টি নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আয়ের ওপর। যত বেশি কলকারখানা, প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তত বাড়ে। প্রভাব পড়ে টাকার চাহিদায়। বৈদেশিক আয়ও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তবে সব টাকাই যে ছাপানো নগদ আকারে থাকে তেমন না। বরং মোট টাকার সামান্য অংশই থাকে নগদে ছাপানো। বাকি টাকা অ্যাকাউন্ট স্থানান্তরভিত্তিক। পুরো টাকা কখনও একবারে প্রয়োজন হয় না। যে কারণে সব টাকা ছাপানোরও দরকার হয় না। তবে কোনো কারণে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই কি টাকা ছাপাতে পারে? এক কথায় এই প্রশ্নের জবাব হলো, চাইলেই টাকা ছাপানো যায় না। সব পক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও টাকা ছাপিয়ে বাজারে দিতে অন্তত ১০ মাস সময় লাগে।

প্রথমত, অর্থনীতির আকার ও চাহিদা বিবেচনায় কী পরিমাণ নগদ নোট দরকার সে আলোকে বাজারে টাকা ছাড়া হয়। আর একটি অংশ সব সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকের ভল্টে মজুত রাখা হয়। বাজারে টাকার চাহিদা বাড়লে তখন মজুত কমে। চাহিদা কমলে মজুত বাড়ে। এখন ধরা যাক হঠাৎ করে চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। অন্য সব হিসাব বাদ দিয়ে তখন চাইলেই কি সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে বাজারে দিতে পারে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্টরা জানান, চাইলেই টাকা ছাপানো যায় না। ধরা যাক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামীকাল সিদ্ধান্ত নিল টাকা ছাপানো হবে। তাহলে প্রথমে কাগজ ও কালি কেনার টেন্ডার আহ্বান করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ জন্য অন্তত চার মাস সময় লাগে। আর কাগজ কেনার আদেশ দেওয়ার পর দেশে আসতে লাগে আরও পাঁচ মাস। আবার টাকা মূল্যমানের আলোকে প্রতিটি কাগজ থাকে আলাদা, যেখানে মূল্যমানের জলছাপ থাকে। ফলে প্রতিটি মূল্যমানের ভিত্তিতে কাগজ আনতে হয়। কাগজ-কালি ছাপাখানা পর্যন্ত পৌঁছানোর পর ১০, ২০ ও ৫০, ১০০ টাকার নোট ছাপা শুরুর দিন থেকে বাজারে দিতে অন্তত ১৭ দিন লাগে। আর ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ছাপা শুরুর দিন থেকে বাজারে যাওয়া পর্যন্ত লাগে অন্তত ২৬ দিন। কেননা নোট ছাপানোর পর প্রথমে তা বদ্ধ ঘরে বিশেষ ব্যবস্থায় শুকানো হয়। শুকাতে তিন থেকে সাত দিন সময় লাগে। শুকানোর পর প্রতিটি নোটের ছাপার মান যাচাই করা হয়। মান ঠিক থাকলে তা কাটিং করে বাইন্ডিং করা হয়। এরপর আবার মান যাচাই করে বাক্সবন্দি করে নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বাজারে দেওয়া হয়।

টাকাও এক ধরনের কাগজ। তবে এটি মূল্যবান হয়ে উঠেছে বিনিময় মূল্যের নিশ্চয়তার কারণে। বর্তমানে মোট লেনদেনের বড় অংশ হয় অনলাইনভিত্তিক। বাংলাদেশ ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনের জন্য কিউআর কোডভিত্তিক আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা চালু করেছে। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে মতিঝিল এলাকার ফুটপাতের ১২শ দোকানে এ রকম লেনদেন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ক্যাশলেস হলে নগদ লেনদেন আরও কমবে। পুরো ক্যাশলেস হলে তখন আর ছাপানো নগদ টাকার প্রয়োজনই হবে না।

মুদ্রার প্রচলন শুরুর আগে সভ্যতা বিকাশের শুরুর দিকে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য লেনদেন হতো। এরপর শুরু হলো স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন। সেখান থেকে এলো কাগুজে মুদ্রা। একটি সময় নোট ইস্যু হতো ওই দেশের মজুত স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিপরীতে। পরবর্তী সময়ে এ দুটির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা এবং সরকারি গ্যারান্টির বিপরীতে মুদ্রা ছাপানো শুরু হয়। সরকারি গ্যারান্টির বিপরীতে মুদ্রা বেশি ছাপলে স্বাভাবিকভাবে মূল্যস্ম্ফীতির ওপর চাপ বাড়ে। যে কারণে অনেক হিসাব করে এ ধরনের নোট ইস্যু হয়। অবশ্য নোট ইস্যু করা আর নোট ছাপিয়ে বাজারে দেওয়া এক বিষয় না।

একটি বিষয় পরিস্কার করে বলা যায়, কোনো দেশের পুরো সঞ্চয়ই ছাপানো নোট আকারে থাকে না। দৈনন্দিন ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত চাহিদার ভিত্তিতে বর্তমানে দেশে ছাপানো নগদ টাকার পরিমাণ রয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে। ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো ছিল ব্যাংকগুলোর ভল্টে। বাকি ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিলসহ বিভিন্ন শাখা অফিসের ভল্ট এবং সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখার ভল্টে। মানুষের জমা টাকা বিশেষ করে বড় অঙ্কের জমানো টাকা কেউ কখনও একবারে নগদে তুলে না। যে কারণে চাহিদা মেটানোর জন্য এ পরিমাণ ছাপানো টাকাই যথেষ্ট।

দেশে মোট ছাপানো নোট এ রকম থাকলেও গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আছে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জমানো আছে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো।

এর বাইরে বীমা, শেয়ারবাজার বা এনজিওতে জমানো সঞ্চয় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রির বিপরীতে গত এক বছরে বাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উঠে এসেছে। এর মানে ওই পরিমাণ তারল্য কমেছে। এখন বাজারে তারল্য বাড়াতে সরকারের ঋণ চাহিদার বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিচ্ছে। আবার ৫০ হাজার কোটি টাকার পাঁচটি পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি চালু করেছে। এসব নোট যে ছাপিয়ে বাজারে দেওয়া হবে তেমন না। বরং অধিকাংশই হবে অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরভিত্তিক।

ওবায়দুল্লাহ রনি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.