আট বছর আগে ২০১৪ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন তিনি। ৮৭ বছরের জীবদ্দশায় কয়েক শ গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন ছত্তার পাগলা, তবে তাঁর সব গান সংরক্ষণ করা যায়নি। এর মধ্যে ‘তওবা কইরা বল খেলাডা ছাড়’, ‘কাঙ্গাল মাইরা জাঙ্গাল দিলে গোনাহ হইবো তোর’, ‘ইঞ্জিন ছাড়া ঠেলাইয়া নেই খালি মালগাড়ি’র মতো কয়েকটি গান নেত্রকোনা ছাপিয়ে হাওরাঞ্চলে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
কাতার বিশ্বকাপের উন্মাদনার মধ্যে গানটি ‘ভাইরাল’ হওয়ায় হাওরাঞ্চল ছাপিয়ে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষীর মুখে মুখে ঘুরছেন ছত্তার পাগলা। ৯ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মোহাম্মদ পারভেজকে উদ্দেশ্য করে গানটি লিখেছেন বলে জানিয়ে গেছেন ছত্তার পাগলা।
৬০ ছুঁই ছুঁই মোহাম্মদ পারভেজ জানালেন, প্রায় ৪০ বছর আগে তাঁর বাবা গানটি লিখেছিলেন; তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর। তিনি বলেন, ‘তখন আমি বল খেলতাম। বল খেলে পা ভেঙে ফেলেছিলাম। তখন আমাকে উদ্দেশ্য করে গানটি লিখেছিল বাবা।’
ছত্তার পাগলার নেশা কিংবা পেশা—দুই-ই ছিল গান বাঁধা। সত্তর-আশির দশকে রেলস্টেশন কিংবা হাটবাজারে গানের মজমা জমিয়ে তুলতেন তিনি। শৈশবে বাবার গানের সঙ্গী ছিলেন পারভেজ ও তাঁর ছোট বোন পারভিনা। পারভিনার হাতে থাকত ডুগডুগি আর গানের ফাঁকে বাঁশি বাজাতেন ছত্তার। সেই বাঁশি যেনতেন বাঁশি নয়, নিজের উদ্ভাবিত বাঁশি। পেঁপেগাছের ডগা দিয়ে বাঁশির কাজ চালিয়ে নিতেন তিনি। ছত্তারের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে আট আনা, চার আনা পয়সা দিতেন দর্শক।
‘ভাইরাল’ ভিডিওর নেপথ্যে
ছত্তার তালুকদারের জন্ম নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার লালচাপুর গ্রামে, সেখানেই বেড়ে ওঠা। মুক্তিযুদ্ধের পর পুরো পরিবার নিয়ে পাশের উপজেলা বারহাট্টার নুরুল্লাচর গ্রামে বসতি গড়েন। আমৃত্যু সেখানেই বাস করেছেন তিনি।
নেত্রকোনার কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক রইস মনরম বলছেন, গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকে নেত্রকোনার প্রতিটি গ্রামে লেটো গানের দল ছিল, শৈশবে রাতে ঘর পালিয়ে গান শুনতে শুনতে গানের প্রতি আসক্তি জন্মে ছত্তারের। একসময় নিজেও একটি লেটো গানের দলে ভিড়েছিলেন তিনি; পায়ে ঘুঙুর পরে মেয়ে সেজে নাচতেন। পরে গানের দল ছেড়ে নিজেই গান লেখা শুরু করেন, সুর তুলে নিজেই সেই গান পরিবেশন করেন।
তরুণ বয়সে রেলস্টেশন ও হাটবাজারে গান করে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পেলেও কখনো নেত্রকোনা শহরের সাংস্কৃতিক আয়োজনে গাওয়ার সুযোগ মেলেনি তাঁর। আশির দশকে নেত্রকোনা শহরে একটি গানের আয়োজনে ছত্তারের গান পরিবেশনের বন্দোবস্ত করেন কবি রইস মনরম।
তবে ছত্তারের সঙ্গে একমঞ্চে গাইতে অস্বীকৃতি জানান শিল্পীরা, ছত্তারকে তাচ্ছিল্য করেন তাঁরা। সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে রইস মনরম জানালেন, আপনাদের কাউকে গাইতে হবে না, মঞ্চে শুধু ছত্তার পাগলা গাইবেন। এরপর ছত্তার গান ধরেন, বাকি শিল্পীরাও ধীরপায়ে মঞ্চে ফিরতে থাকেন। সেদিন ছত্তারের সঙ্গেই গেয়েছিলেন তাঁরা।
জীবদ্দশায় ছত্তার পাগলা স্টুডিওতে কোনো গানের রেকর্ডিংও করেননি, অ্যালবামও বের হয়নি। ‘তওবা কইরা বল খেলাডা ছাড়’ গানের যে ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়েছে, তা ধারণ করেছেন নির্মাতা ও লোকসংগীত সংগ্রাহক মোল্লা সাগর। তিনি জানান, ২০০৭ সালের দিকে তাঁরা ছত্তার পাগলার বাড়িতে গিয়ে কয়েকটি গানের ভিডিও ধারণ করেন, এর মধ্যে এটি একটি। পরে নিজের নির্মিত চল মন নাটক দেখতে যাইতে গানটি ব্যবহার করেছেন মোল্লা সাগর।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে লাইফ বাংলাদেশ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করেন মোল্লা সাগর; মূলত সেখান থেকেই এ গানের খণ্ডিতাংশ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। মোল্লা সাগর বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই গানের কিছু অংশ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখি, অনেকে পুরো গানটার কথা জানে না। পুরো গান শুনলে ছত্তার পাগলার গানের মুনশিয়ানা বোঝা যেত।’
জীবদ্দশায় কয়েক শ গান রচনা করেছেন ছত্তার পাগলা। নিজে খুব একটা লিখতে পারতেন না। তাঁর পরিবারের সদস্য কিংবা গানের অনুরাগীরা তাঁর কাছ থেকে শুনে শুনে গান লিখে দিতেন। তাঁর সব গান উদ্ধার করা না গেলেও শ খানেক গান সংরক্ষণ করা গেছে। ছত্তার পাগলা মৃত্যুর আগে নেত্রকোনার কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক রইস মনরমের কাছে গানগুলো রেখে গেছেন।
সংগ্রহে থাকা ছত্তার পাগলার এসব গান বই আকারে প্রকাশের পরিকল্পনার কথা জানালেন রইস মনরম।