যুদ্ধবিরতি বা আলোচনা ছাড়া আপাতত এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার বিকল্প কোনো পথ নেই প্রেসিডেন্ট পুতিনের। অন্তত এই মুহূর্তে। রুশ বাহিনীও এখন ক্লান্ত। অস্ত্রের সরবরাহ কমে গেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো চাইছে ইউক্রেন আলোচনার টেবিলে বসুক। পুতিনের যুদ্ধবিরতির ইচ্ছা আর পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে কিয়েভকে আলোচনার পরামর্শ দেওয়ার বিষয়টিতে ইউক্রেন সাড়া দিচ্ছে না। পশ্চিমা মিত্রদের পরামর্শে কিয়েভ আলোচনায় আসুক পুতিনও সেটাই চাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সিএনএর রাশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক ও রাশিয়ার সামরিক বাহিনী বিষয়ে নেতৃস্থানীয় একজন বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান। তিনি বলছেন, ‘একটি আগাম অস্ত্রবিরতি হলে দুই পক্ষ পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পাবে।
আর যুদ্ধে রাশিয়া এখন পিছিয়ে পড়ায় এর সবচেয়ে বড় সুফল পাবে রাশিয়া। এরপর নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে পারবে। তাই যুদ্ধবিরতি হলেও যুদ্ধ চলবেই। এই যুদ্ধবিরতি যুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণগুলোর একটিরও সমাধান আনবে না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া ইতিমধ্যে নতুন করে অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার কাজ শুরু করেছে। কফম্যান বলেন, ‘এই যুদ্ধের ফলাফল কী হবে, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি হচ্ছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ সরবরাহ নিশ্চিত করা। আপনি যদি ৯০ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ ব্যবহার করেন, তাহলে এক মাসের মধ্যে তা তৈরি করা সম্ভব নয়। ফলে এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে, কী হারে গোলাবারুদ তৈরি হচ্ছে এবং উৎপাদিত এসব গোলাবারুদের মধ্যে কী পরিমাণ যুদ্ধের ময়দানে সেনাদের কাছে পাঠানো যাচ্ছে।’
প্রকাশিত তথ্যের বরাতে কফম্যান বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে গোলাবারুদ সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য এখন রাশিয়ার কোনো কোনো কারখানায় দুই থেকে তিন পালায়ও কাজ হচ্ছে। এতে বোঝা যায়, তাদের গোলাবারুদ তৈরি করার পর্যাপ্ত উপকরণ রয়েছে। আর তা না হলে দু–তিন পালায় কাজ হতো না।
এরপরও আমেরিকা ও পশ্চিমের কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি বা সমঝোতার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তাঁরা এ বিষয়ে কিয়েভকে চাপ দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ মার্ক মিলে সম্প্রতি বলেছেন, ‘যখন সমঝোতার একটি সুযোগ আসবে, যখন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সেই সুযোগটা নিতে হবে। ওই সময়টাকে ধরতে হবে।’
অবশ্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতি বা সমঝোতা নিয়ে তাঁদের কথায় সায় দিচ্ছেন না। গত মাসে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি–২০ জোটের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা রাশিয়াকে সময়ক্ষেপণ করে নতুন করে তাদের বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দেব না।’ এদিকে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামো লক্ষ্য করে রুশ বাহিনীর হামলায় আসন্ন শীত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে কিয়েভ।
এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনীয়দের পরিস্থিতি তুলে ধরে গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সে ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো বলেন, ‘ইউক্রেনীয়দের কাছে সমঝোতার বিষয়টি কেমন মনে হচ্ছে, সেটা একবার ভেবে দেখুন। কল্পনা করুন, আপনি নিজের ঘরে বসে আছেন। ঘাতকেরা আপনার বাড়িতে এসে আপনার স্ত্রীকে হত্যা করছে, আপনার মেয়েকে ধর্ষণ করছে, এরপর আপনাকে দ্বিতীয় তলায় ডেকে নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আপনাদের সামনে বলছে, আসুন আলোচনা করি। তখন আপনার প্রতিক্রিয়াটা কেমন হবে?’
ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কোর এই কথায় বোঝা যায়, ইউক্রেনে এখন বাস্তবে যা ঘটছে, তাতে যুদ্ধবিরতি করে প্রকৃতই কোনো লাভ নেই, তা আলোচনার মাধ্যমে হোক বা না হোক। যুদ্ধবিরতি হলে বরং রাশিয়া এর ফসল ঘরে তুলবে। হাঁসফাঁস করতে থাকা রাশিয়ার জন্য এখনা যুদ্ধবিরতি গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ফেলো জেনারেল মাইক রায়ান বলছেন, ‘যুদ্ধবিরতি রাশিয়াকে যেমন নতুন করে সংগঠিত ও অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে, একই সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত রুশ সেনাদের বিশ্রাম নেওয়ারও একটি সুযোগ তৈরি করে দেবে এটা। গত ৯ মাসের যুদ্ধে রুশ সেনারা সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন। যুদ্ধ করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়েছেন।’
যুদ্ধের শুরু থেকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে সবচেয়ে বিশ্বস্ত তথ্য দিয়ে আসছে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। গত সোমবার ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দক্ষ সেনা ও গোলাবারুদ–সংকটে পড়েছে রুশ বাহিনী। এতে তাদের আক্রমণ করার ও প্রতিরক্ষার ক্ষমতা অনেক কমতে থাকবে।’
ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিরক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির ক্রিস ডোয়াটি বলছেন, ‘এই যুদ্ধে রাশিয়া আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করবে এবং সেনা মোতায়েন করতে থাকবে। অন্যদিকে রাশিয়ার ধারণা, ন্যাটো, পশ্চিমা মিত্র ও ইউক্রেনীয়রা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা আর এভাবে চালিয়ে নিতে চাইবে না। আর এতে কিয়েভ রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হবে। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিন এটাকেই তাঁর বাজি হিসেবে ধরেছেন।’