এবারের শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার ৮টিতে খোঁজ নিয়ে তিনটি সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়: ১. শূন্য পাসের হারের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসংখ্যা কম। ২. শিক্ষার্থীদের অনেকে বিদ্যালয়ে অনিয়মিত। ছাত্রীদের কেউ কেউ বাল্যবিবাহের শিকার ও ছাত্রদের কেউ কেউ করোনাকালে শিশুশ্রমে নিযুক্ত হয়েছে। ৩. শিক্ষকদের দক্ষতা ও পাঠদানে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অবশ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে সরকারের ব্যয় আছে। কারণ, এতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। শিক্ষকদের অনেকে সরকারের কাছ থেকে বেতনের মূল অংশ ও ভাতা পান। হাজীপাড়া উচ্চবিদ্যালয়টিও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত (নিম্নমাধ্যমিক) এমপিওভুক্ত। মাধ্যমিক স্তরের এমপিওভুক্তির আশায় শিক্ষকেরা নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা চালাচ্ছেন।
অভিযোগ আছে, যেনতেনভাবে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ‘নানাভাবে’ পাঠদানের সরকারি অনুমোদনও পাওয়া যায়। পরে অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তও হয়ে যায়। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেনি, তাদের বিষয়ে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত রোববার বলেছিলেন, শাস্তি নয়, কীভাবে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়, সে ক্ষেত্রে তাঁরা সহায়তা করতে চান।
যে আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে একটি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মহিলা কামিল মাদ্রাসা। সেখান থেকে এবার দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিল ১৯ জন। কিন্তু কেউই পাস করেনি। অথচ মাদ্রাসাটি ২৫ বছর ধরে এমপিওভুক্ত। মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে এ বছর দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ছাত্রীদের মাত্র ২৬ দিন ক্লাস হয়েছে। খারাপ ফলের অন্যতম কারণ তাদের ঠিকমতো পাঠদান করা যায়নি।
সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন শূন্য পাস করা ৯টি বিদ্যালয় গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রাজশাহী, যশোর ও জামালপুরের। আর ৪১টি মাদ্রাসা ২১টি জেলায় অবস্থিত—টাঙ্গাইল, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, যশোর, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, ভোলা, রাজশাহী, শেরপুর ও কক্সবাজার।
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার গালদা খড়িঞ্চা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার মাত্র একজন পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু পাস করতে পারেনি। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। বিদ্যালয়টিতে আটজন শিক্ষক এবং তিনজন কর্মচারী এমপিওভুক্ত। এই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল পাঁচজন। তিনজন নির্বাচনী পরীক্ষা দিয়ে পাস করে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করে। কিন্তু এর মধ্যে দুজনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এসএসসি পরীক্ষার অংশ নেয়নি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোশাররফ হোসেনের দাবি, আগে এত খারাপ ফল হয়নি।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার তিনটি মাদ্রাসার কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি। এর মধ্যে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর দাখিল মাদ্রাসাটি ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ও ১৯৯৪ সালে এমপিওভুক্ত হয়। এখন ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত। এ বছর এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১২ জন দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু কেউ পাস করতে পারেনি।
উল্লাপাড়ার বাঙ্গালা ইউনিয়নের ইসলামপুর (মাঝিপাড়া) ধরইল দাখিল মাদ্রাসাটি ১৯৮৫ সালে এমপিওভুক্ত হয়। এবার ১০ জন দাখিল পরীক্ষা দিয়ে সবাই অকৃতকার্য হয়। উপজেলার বড় পাঙ্গাসী ইউনিয়নের বড় পাঙ্গাসী খন্দকার নুরুন্নাহার জয়নাল আবেদীন দাখিল মাদ্রাসাটি ১৯৯৫ সালে এমপিওভুক্ত হয়। এখান থেকে এবার ১১ জন দাখিল পরীক্ষা দিলেও সবাই ফেল করে।
কালিকাপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, তাঁদের ১২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৭ জন ছাত্রী, ৫ জন ছাত্র ছিল। করোনাকালে ছাত্রীদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গায় কাজে যুক্ত হয়েছে। এরপরও অনেক চেষ্টা করে তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানো হয়েছিল।
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার কুঞ্জমহিপুর দ্বিমুখী গার্লস স্কুল থেকে এবার তিনজন ছাত্রী এসএসসি পরীক্ষা দিলেও একজনও পাস করতে পারেনি। জামালপুর সদর উপজেলার বিজয়নগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে সাতজন পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করেছে।
‘এগুলো আসলে বোঝা’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান থাকার দরকার নেই। এগুলো আসলে বোঝা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলতে হলে ন্যূনতম সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকার নিয়ম আছে। তাই যেসব প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম শিক্ষার্থী নেই, সেগুলোর স্বীকৃতি বাতিল করে দেওয়া উচিত।