আনোয়ার ইব্রাহিমের ওই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, তা কিছু সময়ের মধ্যেই বোঝা যায়। একপ্রকার তরতরিয়ে রাজনৈতিক জীবনে শীর্ষের দিকে ওঠেন তিনি। এমনকি পালন করেছেন একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ১৯৯৩ সালে তিনি মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী হন। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ।
ধারণা করা হতো, মাহাথিরের পরে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে তাঁর জায়গা নেবেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তবে বাদ সাধে ১৯৯৭ সালে এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট। এমন পরিস্থিতিতে দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। শেষমেশ ১৯৯৮ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় আনোয়ার ইব্রাহিমকে।
কারাবাস
উপপ্রধানমন্ত্রী পদ হারানোর পর মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন আনোয়ার ইব্রাহিম। ওই বিক্ষোভ ‘রিফোর্মাসি’ নামে বিখ্যাত। এরপর তাঁকে সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
মালয়েশিয়া মুসলিমপ্রধান দেশ। সমকামিতা দেশটির আইনে অপরাধ। তবে দেশটির আদালতে কেউ সমকামিতার দায়ে সাজা পেয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল। আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে সমকামিতার মামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিন্দার ঝড় তুলেছিল। বলা হতো, রাজনৈতিক কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে ওই মামলা করা হয়েছিল।
পরে আদালতের রায়ে দুর্নীতির অভিযোগে আনোয়ার ইব্রাহিমকে ছয় বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেন মালয়েশিয়ার আদালত। এর জেরে সে সময় দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর পরের বছরই সমকামিতার অভিযোগে আরও ৯ বছর কারাদণ্ডের সাজা পান তিনি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আনোয়ার ইব্রাহিম সব সময়ই দাবি করেছেন, রাজনীতিতে তাঁকে পথের কাঁটা হিসেবে দেখতেন মাহাথির মোহাম্মদ। এ জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁর রাজনীতির মাঠ থেকে সরাতে চেয়েছিলেন তিনি। যদিও মাহাথিরই একসময় তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন।
২০০৩ সালে মাহাথির অবসর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে যাওয়ার পর ২০০৪ সালে আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে সমকামিতার রায় স্থগিত করেন আদালত। ফলে কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
উঠতি বিরোধী দল
কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নতুন একটি বিরোধী দলের প্রধান হিসেবে আবির্ভাব হয় আনোয়ার ইব্রাহিমের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিজেদের শক্ত অবস্থানের জানান দিয়েছিল দলটি। তবে সে বছরই আবার আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ তোলা হয়। সেবারও অভিযোগ নাকচ করেন তিনি।
প্রমাণের অভাবে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ খারিজ করে দেন আদালত। এর পরের বছরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নতুন উচ্চতায় ওঠে তাঁর বিরোধী দল। সেবার স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ ফল করে ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল জোট।
তবে আবারও আনোয়ার ইব্রাহিম হোঁচট খান। ২০১৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তাঁর বিরুদ্ধে আনা সমকামিতার অভিযোগ খারিজের আগের রায় স্থগিত করেন আদালত। ফলে তাঁকে আবারও ফিরে যেতে হয় কারাগারে।
রাজনীতিতে ফিরে আসা
২০১৬ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে অবসর থেকে বেরিয়ে এসে আবার প্রধানমন্ত্রী পদে আসার ঘোষণা দেন মাহাথির মোহাম্মদ। সে সময় ৯২ বছর বয়সী এই নেতার ভাষ্য ছিল, তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রিত্বে ফিরে আসার পথ তৈরি করতে গিয়ে আবার ব্যতিক্রমী এক পদক্ষেপ নেন মাহাথির। কারাবন্দী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন তিনি। কারাগারে থেকেও সে সময় দেশবাসীর কাছে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।
ওই সমঝোতার পর সবাইকে চমকে দিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে করমর্দন করেন মাহাথির। পথচলা শুরু হয় নতুন একটি রাজনৈতিক জোটের। মাহাথিরের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই পাকাতান হারাপান জোট জয়লাভ করে। এর মধ্য দিয়ে টানা ৬১ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বারিসান ন্যাশনালের পতন হয়।
মালয়েশিয়ার নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবার দায়িত্ব নেন মাহাথির মোহাম্মদ। ক্ষমতায় বসার পর আনোয়ার ইব্রাহিমকে পূর্ণ ক্ষমার সুযোগ দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। বলেন, দুই বছরের মধ্যে আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথাও।
অবশেষে লক্ষ্য পূরণ
তবে এই ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রিত্ব নিজের হাতে রাখতে গড়িমসি শুরু করেন মাহাথির মোহাম্মদ। পরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি অপ্রত্যাশিতভাবে মাহাথিরের অবসরের পর ভেঙে পড়ে পাকাতান হারাপান জোট। রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে মালয়েশিয়া। আবার আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন হাতছাড়া হয়।
জোট সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসে ইউনাইটেড মালায়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও)। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। তবে এক বছর পরই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন ইউএমএনওর ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব। চলতি বছরের অক্টোবরে আগাম নির্বাচনের ডাক দেন তিনি।
এই নির্বাচনে পার্লামেন্টে সর্বাধিক আসন পায় আনোয়ার ইব্রাহিমের জোট পাকাতান হারাপান। তবে সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার পায়নি তারা। এ নিয়ে বেশ কয়েক দিন অনিশ্চয়তার পর মালয়েশিয়ার রাজা আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এর মধ্য দিয়ে অবসান হয় তাঁর দীর্ঘ ২৫ বছরের অপেক্ষার।