১২ টাকা কেজি ধরে কমলার এলসি খোলা হয়েছে। ১৮ টাকা কেজিতে আপেল, খেজুরের এলসি হয়েছে ২০ টাকায়। কোটি টাকার মার্সিডিজ বেঞ্জ আনা হচ্ছে ২০ লাখ টাকা দর দেখিয়ে। কর ফাঁকি দিতে এভাবে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (দর কম দেখিয়ে) মাধ্যমে পণ্য আমদানি হচ্ছে। এর মাধ্যমে একদিকে কর ফাঁকি এবং অন্যদিকে অর্থ পাচার হচ্ছে। গতকাল সোমবার গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংকের এমডিদের নিয়ে জরুরি এক বৈঠকে এমন চিত্র তুলে ধরে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণের নিশ্চয়তায় ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমে ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহের কারণ জানতে এ বৈঠক ডাকা হয়। যদিও আলোচনার মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় পণ্যের দর কম দেখিয়ে আমদানি, এলসি খুলতে না পারার দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর চাপানো ও গুজবের কারণে আমানত তুলে নেওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে গতকাল সকাল ১১টায় সব ব্যাংকের এমডির সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে বিকেল ৪টায় সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন।
জানা গেছে, এমডিদের বৈঠকে কমলা, আপেল, খেজুর ও গাড়ি আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের চিত্র তুলে ধরে গভর্নর বলেন, পণ্যের দর কম বা বেশি দেখিয়ে বছরের পর বছর এলসি খোলা হয়েছে। এতে একদিকে সরকারের কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, আরেকদিকে অর্থ পাচার হচ্ছে। বাইরে থেকে প্রবাসীর আয় কিনে দরের বাকি অর্থ অবৈধ উপায়ে পরিশোধ হচ্ছে। ফলে রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না; হুন্ডির মাধ্যমে এখানে সুবিধাভোগীকে টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। এর দায় সংশ্নিষ্ট ব্যাংক এড়াতে পারে না। এ ধরনের এলসি খোলার সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিভিন্ন গুজবে আমানত তুলে নেওয়ার সাম্প্রতিক প্রবণতা তুলে ধরে গভর্নর বলেন, ব্যাংক খাতের সুদৃঢ় অবস্থান ও তারল্য সংকট না থাকার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার দায়িত্ব ব্যাংকগুলোরও রয়েছে। ব্যাংকগুলোর জনসংযোগ বিভাগের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি এ ধরনের গুজবের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে কোনো ব্যাংক যেন আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ না হয়, সেদিকে সজাগ হওয়ার পরামর্শ দেন।
বৈঠকে গভর্নর বলেন, এলসি খুলতে পারা-না পারা ব্যাংকের নিজস্ব সক্ষমতার বিষয়। অথচ অনেক গ্রাহককে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণে ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিধিনিষেধ নেই। ব্যাংকের নিজস্ব সক্ষমতার আলোকে ডলার সংস্থান করে সব ব্যাংক এলসি খুলতে পারবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালার আলোকে তদারকি অব্যাহত রাখবে।
গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকের আমানত তুলে নেওয়ার ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ বলেন, ব্যাংকে আমানত সুরক্ষিত কিনা জানতে চেয়ে দেশ-বিদেশ থেকে গভর্নরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে টেলিফোন আসছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকের আমানত তুলে নিতে ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রচারের ফলে এমন হচ্ছে। এ ধরনের গুজব ঠিক নয়। ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ় আছে। তারল্যের কোনো সংকট নেই। বর্তমানে ব্যাংক খাতে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। একটি ব্যাংকও সিআরআর, এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে না। তারল্য সংকট তৈরি হলে তেমন ঘটত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, পত্রিকার মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারছেন, অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক এলসি খোলা বন্ধ আছে। বিষয়টি সঠিক নয়। এ ধরনের এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে নীতিমালার আলোকে তদারকি করা হচ্ছে। বিশেষ তদারকিতে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। গত জুলাই থেকে কঠোর তদারকির ফলে তা কমেছে। তবে আজ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রায় কোনো ঋণখেলাপি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক তা হতেও দেবে না। অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় জ্বালানি, সার ও খাদ্য আমদানিতে সরকারি ঋণপত্রে ডলার সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
তিনি জানান, এলসি খোলা বন্ধ নেই। চলতি মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ১২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। আগের মাসের একই সময়ে যা ছিল ১২৩ কোটি ডলার। গত অক্টোবরে ৪৭৪ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। গত ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ৬৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে যা প্রায় দুই কোটি ডলার বেশি। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চাহিদা ও সরবরাহে অনেকটাই ভারসাম্য অবস্থা তৈরি হবে।