৮৫ বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে ‘দত্তের মিষ্টি’র সুনাম

0
195
গোপালগঞ্জের দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডারের ছানার সন্দেশ

ছোট টিনের ঘর। ঘরের ভেতরে সামনের দিকে গ্লাস দিয়ে ঘেরা মিষ্টি রাখার জায়গা। দেখতে আর দশটা সাধারণ দোকানের মতো হলেও গুণ, মান আর স্বাদে আট দশকেরও বেশি সময় শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে দোকানটি। নাম ‘দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডার’। গোপালগঞ্জ শহরের ডিসি মার্কেট এলাকায় এর অবস্থান।

দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে গোপালগঞ্জ শহরের তৎকালীন মুনসেফ আদালত (বর্তমানে গোপালগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়) এলাকার আমগাছের নিচে ছোট একটা ঘরে দোকানটির যাত্রা। বসন্ত দত্ত তাঁর ১৪ বছরের ছেলে সুধীর দত্তকে নিয়ে মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। মিষ্টি বিক্রির টাকা দিয়ে চলত তাঁর সংসার। বসন্ত দত্তের মৃত্যুর পর দোকানের হাল ধরেন সুধীর দত্ত। দিন দিনে মানুষের মুখে মুখে দত্তের মিষ্টির নাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে সুধীর দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে পবিত্র দত্ত, সুচরিত দত্ত ও সবুজ দত্ত দোকানটি পরিচালনা করছেন। ৮৫ বছর ধরে চলছে দোকানটি।

দেখতে আর দশটা সাধারণ দোকানের মতো হলেও গুণ, মান আর স্বাদে আট দশকেরও বেশি সময় শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডার
দেখতে আর দশটা সাধারণ দোকানের মতো হলেও গুণ, মান আর স্বাদে আট দশকেরও বেশি সময় শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডার

অনেক দিন এক জায়গায় দোকানটি থাকার পর ১৯৯৮ সালে স্থান পরিবর্তন করে। দোকানের পশ্চিম দিকে পৌরসভা, দক্ষিণে জেলা প্রশাসনের সুশাসন চত্বর, পূর্ব দিকে আইনজীবী সমিতির ভবন, উত্তর দিকে আদালত প্রাঙ্গণ হলেও সাধারণ মানুষের কাছে জায়গাটি ‘দত্তের মোড়’ হিসেবে পরিচিত।

অন্য দোকানের মিষ্টি বাড়ির লোক পছন্দ করে না।

দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডারের বর্তমান মালিকদের একজন পবিত্র কুমার দত্ত বলেন, ‘ঠাকুরদা শুধু করেছিলেন। এরপর বাবা। এখন আমরা দোকানটি চালাই। দত্তের মিষ্টির সুনাম এক দিনে হয়নি। সেই সুনাম ধরে রাখাও সহজ ব্যাপার নয়। সুনাম ধরে রাখতে হলে মিষ্টির গুণগত মান ঠিক রাখতে হয়। দত্তের মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত দুধ কিংবা অন্য উপকরণ ফ্রিজে রাখা হয় না। ফ্রিজে রাখলে স্বাদ আর মান ঠিক থাকে না। মিষ্টিতে সাধারণত মিল্ক পাউডার, রং ও সুজি ব্যবহার করে ভেজাল দিয়ে থাকে। আমরা এগুলো ব্যবহার করি না। আমাদের তৈরি রসগোল্লা ও সন্দেশ তুলনামূলক কম মিষ্টি, তাই মানুষ এতটা পছন্দ করে।’

২০২২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ২০ কেজি ছানার সন্দেশ পাঠানো হয়।

মিষ্টি বানানো ও অন্যান্য কার্যক্রম কীভাবে চলে, জানতে চাইলে পবিত্র কুমার দত্ত বলেন, আগে গোপালগঞ্জে পর্যাপ্ত দুধ পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যায় না। তাই তাঁরা বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার কয়েকজন দুধ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দুধ নেন। সেই দুধ দিয়ে তৈরি হয় দত্তের মিষ্টি। প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার রসগোল্লা, ২০ কেজি ছানার সন্দেশ, ১৫ থেকে ২০ কেজি চমচম ও কালোজাম তৈরি করা হয়। প্রতিটি রসগোল্লা ১০ টাকা, ছানার সন্দেশ প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, চমচম ও কালোজাম ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। দিনের মিষ্টি দিনেই বিক্রি হয়ে যায়; বরং দুধের জোগানের অভাবে মিষ্টি বানাতে না পেরে প্রতিদিন অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন ক্রেতাকে ফিরিয়ে দিতে হয়।

একেকটি রসগোল্লা ১০ টাকায় বিক্রি হয়
একেকটি রসগোল্লা ১০ টাকায় বিক্রি হয়

গোপালগঞ্জে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানসহ যেকোনো আয়োজনে দত্তের মিষ্টি থাকে উল্লেখ করে পবিত্র কুমার দত্ত বলেন, ‘আমাদের মিষ্টি ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অনেক দেশে যায়। ২০১৯ সালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের দোকানে বসে মিষ্টি খেয়েছেন। ২০২২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ২০ কেজি ছানার সন্দেশ পাঠানো হয়।’

দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডারে ১২ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আছেন, যাঁরা ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন। ৩০ বছর ধরে এই দোকানে কাজ করা ফেরদাউস দাড়িয়া বলেন, ‘এখানে দীর্ঘদিন আনন্দের সঙ্গে কাজ করছি। মানুষ যখন দত্তের মিষ্টির সুনাম করে, ভালো বলে, তখন নিজের ভেতর ভালো লাগে।’

দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডারে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার রসগোল্লা বানানো হয়
দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডারে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার রসগোল্লা বানানো হয়

দত্তের মিষ্টি কিনতে আসা গোপালগঞ্জের নবীনবাগ এলাকার আশরাফুল আলম বলেন, ছোটবেলায় এই মিষ্টি খেতেন। বড় হয়েও এই মিষ্টিই কেনেন। বিদেশে আত্মীয়স্বজনের কাছেও এই মিষ্টি পাঠান। অন্য দোকানের মিষ্টি বাড়ির লোক পছন্দ করে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.