ইসলাম উদ্দিনের কিচ্ছা

0
187
শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মঞ্চে পালা পরিবেশন করছেন ইসলাম উদ্দিন।

১৭ বছর বয়সে পালাগানের নেশায় ঘর পালান ইসলাম উদ্দিন, ওস্তাদের সঙ্গে ৯ মাস ঘুরে পালাগানের রসদ নিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি। চার দশকের ক্যারিয়ারে পালাগান নিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিলেত ঘুরে এসেছেন তিনি; এবার কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেওরা’ গানে নিজের জাত চেনালেন ইসলাম উদ্দিন।

‘ওস্তাদের কাছে পালাগান শিখতে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বের হয়েছিলাম। ওস্তাদের (কুদ্দুস বয়াতি) সঙ্গে ৯ মাস ঘোরাঘুরি করে পালাগান শিখে বাড়ি ফিরলাম,’ কৈশোরের শেষভাগে ঘর পালানোর গল্প বলছিলেন ইসলাম উদ্দিন।

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
নব্বইয়ের দশকে দম ফেলার ফুসরত মিলত না ইসলাম উদ্দিন পালাকারের। তাঁর ‘শিডিউল’ পেতে ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকত। ইসলাম উদ্দিনের ভাষ্যে, ‘তখন মাসে ৩০ থেকে ৩৫টি পালাগানের অনুষ্ঠান করতাম; দিনে-রাতে সমানতালে করেছি। এমনও হয়েছে, আমি পুরো সপ্তাহের জন্য পালা করতে বের হয়ে গেছি। শেষ করে বাসায় ফিরে দেখি, আমাদের বায়না করার জন্য অনেকে অপেক্ষায় আছেন।’
শূন্য দশক থেকে পালাগানের আসর কমতে থাকে, এখন পুরো মাসে দু-তিনটির বেশি বায়না মেলে না। ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘ডিজিটাল যুগ আসার পর থেকে পালাগান আস্তে আস্তে কমে গেছে। এখন ইউটিউবে সার্চ দিলেই পালাগান দেখা যায়। ফলে পালাগানের আসর এখন বিলুপ্তের পথে। আমরাও যদি ছেড়ে দিই, তাহলে হয়তো এটা এলাকায় আর না–ও থাকতে পারে। আমাদের ধরে রাখতে হবে, আমরা যে গানগুলো শুনেছি, সেই গানগুলো আমাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো আর শুনতে পাবে না।’

‘দেওরা’ গান পরিবেশন করছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার
‘দেওরা’ গান পরিবেশন করছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকারছবি: সংগৃহীত

ইসলাম উদ্দিনের পর কে
তাহলে আপনার এলাকার পালাগানের ভবিষ্যত কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছেন, ‘আমার পরে কেউ থাকবে কি না, তা বলতে পারব না। পালাগান মূলত ওস্তাদ-শিষ্যের পরম্পরার মানুষের মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এখনো শিষ্য হিসেবে কাউকে পাইনি, পেলে গানগুলো ধরিয়ে দিয়ে যাব। ধৈর্য ধরে পালা শিখতে হবে।’

৯ মাসে লিখলেন প্রথম পালা
২০০৬ সালে ইসলাম উদ্দিন পালাকারের জীবন অবলম্বনে কিচ্ছাদার নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন লোকসংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়া। উপন্যাসটি ২০০৭ সালে অন্যদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাইমন জাকারিয়া গত সপ্তাহে জানান, পালাকারেরা বছরের পর বছর ধরে মানুষের মুখে ছড়িয়ে থাকা পালাগুলোই পরিবেশন করেন। ইসলাম উদ্দিন নিজেই একটি পালা রচনা করেছেন, এটি পালাকারদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।

মঞ্চে ইসলাম উদ্দিন
মঞ্চে ইসলাম উদ্দিন

বছর দুই আগে একটি পালা রচনা করেন ইসলাম উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে লেখা  ইতিহাসনির্ভর পালাটির নাম ‘শেখ রাসেলের করুণ কাহিনি’। তাঁর ভাষ্যে, ‘করোনাভাইরাসের মধ্যে পালাগান করতে পারিনি। তখন চিন্তা করলাম, আমি পালাগান রচনা করব। পালাগানটি লিখতে ৯ মাস লেগেছে। এতে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রাসেলকে নিয়ে গান আছে। প্রধানমন্ত্রীকে পালাটা দেখাতে পারলে ধন্য হতাম।’
‘আমরা যে পালাগুলো করি, সব কাল্পনিক। কে রচনা করেছেন, কেউ বলতে পারবে না। এগুলো মুখে মুখে শিখেছি। বইয়ে লেখা নাই। কাল্পনিক পালাগুলো অভিনয় করে মানুষকে বিশ্বাস করাই। এমনভাবে পালা করতে হয় যেন মানুষ সেটিকে বাস্তব মনে করে,’ বলেন ইসলাম উদ্দিন।

পালাগান নিয়ে বিলেতে
কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেওরা’ গান নিয়ে সর্বমহলে পরিচিতি পেলেও পালাগানের দর্শকের কাছে বহু আগেই পরিচিতি পেয়েছেন ইসলাম উদ্দিন। ১৯৯৯ সালে যুক্তরাজ্য আয়োজিত বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যালে পালাগান করে এসেছেন তিনি। মাঝে অস্ট্রেলিয়ায়ও যাওয়ার কথা ছিল তাঁর, তবে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে প্রশিক্ষণও দিয়েছেন ইসলাম উদ্দিন। বিভাগের প্রযোজনায় মঞ্চে আনা হয় ‘কমলা রানী সাগর দিঘি’; সেখানে প্রশিক্ষণ দেন ইসলাম উদ্দিন। ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নির্মাতা আবু সাইয়ীদের কিত্তনখোলা সিনেমায় গানও করেছেন তিনি।

ফোক ফেস্টে  ইসলাম উদ্দিন
ফোক ফেস্টে ইসলাম উদ্দিন

স্বপ্ন আর কিছু নেই
‘দেওরা’ গানটি প্রচারের পর দেশ ও দেশের বাইরের শ্রোতাদের কাছ থেকে একের পর এক ফোন পাচ্ছেন ইসলাম উদ্দিন। এলাকায় তাঁর কদরও বেড়েছে, অনেকেই তাঁকে গান শোনানোর আবদার করছেন। আপনার স্বপ্ন কী? জানতে চাইলে ইসলাম উদ্দিন বললেন, ‘আমার স্বপ্ন আর কিছু নাই। যে গানটা করছি, গানটা ভাইরাল হইছে, এতেই আমি ধন্য। আমার গান আগেও ভাইরাল হয়েছে। এই গানটা গাওয়ার পর আরও অনেকেই আমাকে চিনতেছে। বিদেশে থেকেও অনেকে ফোন দিচ্ছে। যারা আমাকে আগে দেখেনি, তারাও আমাকে চিনতে পারছে। আমি কোক স্টুডিও বাংলা, প্রীতম হাসান ভাইসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.