সরকারি পর্যায়ে প্রথম ডিগ্রিধারী নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ
ইলিজা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে ডিপ্লোমা ইন ফরেনসিক মেডিসিনে ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) অধীন ফরেনসিক মেডিসিনে এমসিপিএস করেছেন।
২০১১ সালে ইলিজা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড) ফরেনসিক বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি ময়নাতদন্ত ও ধর্ষণের ভুক্তভোগী নারী-শিশুদের ডাক্তারি পরীক্ষা করেন তিনি। সরকারি পর্যায়ে ইলিজা দেশের প্রথম ডিগ্রিধারী নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। তিনি তাঁর কর্মজীবনের শুরুর দিন থেকেই ময়নাতদন্ত করে আসছেন। সরকারি পর্যায়ে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি একমাত্র নারী হিসেবে ময়নাতদন্ত করেন। তবে এখন কয়েকটি হাসপাতালে নারী চিকিৎসকেরা ময়নাতদন্তের দায়িত্ব পালন করছেন।
পরবর্তী সময়ে ইলিজা রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। তিনি হাসপাতালটিতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তিনি সেখানকার ফরেনসিক মেডিসিন ও টকসিকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৭ সালের মার্চ থেকে তিনি এ দায়িত্বে আছেন।
সঠিক প্রতিবেদনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা
ইলিজা বলেন, মানুষ হিসেবে আবেগ থাকলেও ময়নাতদন্তের সময় তা তাঁর মধ্যে কাজ করে না। মৃত্যুটা কীভাবে হলো, সে বিষয়ই কাজের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। প্রতিবেদন যাতে সঠিক হয়, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন তিনি। কোনো কিছু বুঝতে সমস্যা হলে প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। এখন পর্যন্ত তাঁর দেওয়া কোনো প্রতিবেদন কেউ চ্যালেঞ্জ করেননি, করতে পারেননি।
বিভিন্ন সময় ময়নাতদন্ত বা ধর্ষণের শারীরিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পাল্টে দেওয়ার জন্য প্রভাবশালী মহল থেকে চাপ আসে বলে জানান ইলিজা। তিনি বলেন, আবার সাক্ষ্য দিতে না যাওয়া বা সাক্ষ্য দিলেও তা যাতে দুর্বল হয়, সেই চাপও আসে। সাক্ষ্য দিয়ে আদালত থেকে বের হওয়ার সময় গুন্ডাদের পিছু নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ইলিজা তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘একবার বয়স্ক নারীর ময়নাতদন্ত করি। বড় কোনো আঘাতে তাঁর মাথা থেকে মগজ বের হয়ে গিয়েছিল। আসামিরা চাইছিলেন, যাতে আমি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সঠিক তথ্য না লিখি। তাঁরা চাপ দিচ্ছিলেন। মোটা অঙ্কের ঘুষ সেধেছিলেন। কিন্তু আমি অনড় থাকি। হুমকি উপেক্ষা করে সঠিক প্রতিবেদন দিই।’
ইলিজা দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘আমি কখনো কারও চাপে নতিস্বীকার করিনি, করবও না। আমি জানি, আমার দেওয়া প্রতিবেদন শতভাগ সত্য। তাই আমার কোনো ভয় নেই। সঠিক প্রতিবেদন দিচ্ছি, মানুষকে ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা করছি, এটা আমার প্রশান্তির জায়গা।’
ফরেনসিক নারী চিকিৎসক কম
ফরেনসিক বিভাগে নারী চিকিৎসকের গুরুত্বের বিষয়টি নজরে আসে ২০১৩ সালে প্রথম আলোয় ‘ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগ: নারীর জন্য এ কেমন ব্যবস্থা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হলে। তখন হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধানকে তলব করেন, রুল দেন। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে নারী চিকিৎসক, নার্স ও এমএলএসএস নিয়োগের নির্দেশ দেন। ইলিজা বলেন, আদালতের নির্দেশের পরও ফরেনসিক নারী চিকিৎসকের সংখ্যা তেমন একটা বাড়েনি। সংযুক্তিতে বিভিন্ন বিভাগের নারী চিকিৎসক দিয়ে ফরেনসিক বিভাগের কাজ চালানো হচ্ছে।
ফরেনসিক নারী চিকিৎসকের সংখ্যা কম কেন—এ প্রশ্নে ইলিজা বলেন, এ বিষয়ের চিকিৎসকদের প্রণোদনা বা বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। পদোন্নতিসহ নানা বিষয়ে পিছিয়ে থাকতে হয়। তা ছাড়া আদালতে যাওয়াসহ নানা চাপ মোকাবিলা করতে হয়। তাঁর মা–বাবা মানতে পারছিলেন না যে তিনি ফরেনসিক বিষয়ের চিকিৎসক হবেন। তাঁরা তাঁকে অন্য বিষয়ের চিকিৎসক হতে বলেছিলেন।
ইলিজা বলেন, আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার জন্য নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো খরচ বরাদ্দ নেই। কর্মস্থল থেকে আলাদা করে এ জন্য ছুটি পাওয়াও কষ্টকর। সাক্ষ্য দিতে গেলে সব সময় যে ভালো আচরণ পাওয়া যায়, তা–ও নয়। আর মামলার কোনো পক্ষ যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে তো কথাই নেই।
মর্গের যথাযথ পরিবেশ এখনো গুরুত্ব পায়নি
ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে কখনো ভয় লেগেছে কি না, তা জানতে চাইলে ইলিজা বলেন, ‘সেই অর্থে ভয় লাগেনি। তবে একধরনের অস্বস্তি কাজ করেছে। এমন মনে হয়েছে, এই মানুষটা তো আমাদের মতোই ছিল, কিন্তু এখন লাশ।’
ইলিজা বলেন, দেশে এখন পর্যন্ত মর্গের যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে প্রতিবেদন আসতে সময় লাগে। এ ছাড়া নানা সমস্যার কারণে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দিতে দেরি হয়, যা বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে এমন অভিযোগও শুনতে হয়, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ‘টাকা খেয়ে’ প্রতিবেদন দিতে দেরি করছেন। তবে কেউ চাইলে প্রতিবেদন পাল্টে দিতে পারেন। আবার কখনো ভুল হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
নিজের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইলিজা বলেন, ‘আমি সব সময় মৃত্যুর সঠিক কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কোনো বিষয়ে সন্দেহ হলে তা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠাই। প্রতিবেদন দিতে দেরি হলেও তা যাতে সঠিক হয়, সেই চেষ্টাই সব সময় করি।’
ময়নাতদন্তের কাজটি জটিল উল্লেখ করে ইলিজা বলেন, ‘কখনো কখনো কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, মাথায় যেন পাঁচ মণ বোঝা নিয়ে হাঁটছি। আবার কর্মক্ষেত্রে অনেক বিভিন্ন লোকজন কোণঠাসা করারও চেষ্টা করেছেন।’
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি মর্গ করার জন্য তিনবার নকশা তৈরি করে দিয়েছেন ইলিজা। তবে প্রশাসনিক জটিলতায় তা এখনো আলোর মুখে দেখেনি। তিনি সরকারি মেডিকোলিগ্যাল প্রশিক্ষক হিসেবে অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে নিজের পেশাগত জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।