উখিয়া আশ্রয়শিবিরে কেন একের পর এক রোহিঙ্গাকে হত্যা

0
100
উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি মাসের ২১ দিনে উখিয়ার কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে ৯টি পৃথক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ১০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনজন রোহিঙ্গা। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ছয়জন পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স ছিলেন। মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গতিবিধি, তৎপরতা, অবস্থান সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার কারণে তাঁদের তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগে অন্তত ৪৫ রোহিঙ্গাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে আটকে রেখে বর্বর নির্যাতন করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে অপহরণ আতঙ্কে আশ্রয়শিবির থেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণেই বিকেল চারটার আগেই আশ্রয়শিবিরগুলো থেকে বেরিয়ে পড়েন রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা। বিকেল পাঁচটার পর আশ্রয়শিবিরগুলোর অলিগলিতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও পুলিশের তেমন টহলও দেখা যায় না। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর পুরো আশ্রয়শিবির অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তখন অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা মাঠে নেমে গোলাগুলি, সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ের ঢালু ও চিপা গলির ঘনবসতির আশ্রয়শিবিরগুলোতে যখন-তখন অভিযান পরিচালনাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ঝুঁকি।

চলতি মাসের ২১ দিনে উখিয়ার কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে ৯টি পৃথক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ১০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনজন রোহিঙ্গা।

পুলিশ ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত মঙ্গলবার দুপুরে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১৩) জি-৪ ব্লকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ও গুলিতে দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। নিহত দুজন হলেন ওই আশ্রয়শিবিরে মোহাম্মদ রফিক (৩০) ও রফিক উল্লাহ (৩৪)। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগে গুলি করে এই দুজনকে হত্যা করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীরা। ১৮ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে উখিয়ার তাজনিমারখোলা আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১৯) ডি ব্লকে আরসা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন হাফেজ মাহবুব (২৭) নামের আরেক রোহিঙ্গা। তিনি এপিবিএনের সোর্স ছিলেন।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, নিহত হাফেজ মাহবুব আরসার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সন্ত্রাসীদের অবস্থান এবং মাদক চোরাচালানের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন। এ কারণে ঘর থেকে তুলে নিয়ে মাহবুবকে হত্যা করে আরসার সন্ত্রাসীরা। একই অভিযোগে ১৬ মার্চ উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮) মাহবুবুর রহমান (৩৫) নামের আরেকজন রোহিঙ্গা যুবককে অপহরণের পর ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। ১৫ মার্চ একই আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) পৃথক দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় আবদুর রশিদ (৩০) নামের রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক মারা যান।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিরতার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ও সাতটি ডাকাত দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বশত্রুতার জেরে একাধিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী গোলাগুলি-সংঘর্ষ ও খুনোখুনিতে লিপ্ত রয়েছে।

আশ্রয়শিবিরের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাই চিন্তিত। কারা খুনোখুনিতে জড়িত, কেন হচ্ছে, তা সবারই জানা বিষয়। আশ্রয়শিবিরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যমতে, গত পাঁচ মাসে আশ্রয়শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৩৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা), ৮ জন আরসার সদস্য, ১ জন স্বেচ্ছাসেবক ও অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা। ফেব্রুয়ারি মাসে গুলিতে নিহত হয়েছেন চারজন রোহিঙ্গা ও জানুয়ারি মাসে নিহত হয়েছেন ৩ জন। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ৫৫ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলছে। অনেকে ধরাও পড়ছেন। কিন্তু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। হোতাদের অনেকে আশ্রয়শিবিরের বাইরে অবস্থান করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক রোহিঙ্গা নেতা জানান, কয়েক দিন ধরে সন্ধ্যার পর সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা দল বেঁধে আশ্রয়শিবিরের অলিগলিতে নেমে মহড়া দেয়। এ সময় একপক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। কেউ কেউ রোহিঙ্গা বসতিতে ঢুকে লুটপাট, মেয়েদের শ্লীলতাহানি ও অপহরণের ঘটনা ঘটায়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ রোহিঙ্গাদের চুপ থাকা ছাড়া উপায় নেই। সম্প্রতি একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরসাপ্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি, মাদক চোরাচালানের মূল হোতা ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনসহ ৬০ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় চারটির বেশি পৃথক হত্যা মামলা হলেও কেউ ধরা পড়েননি। সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান দরকার।

আশ্রয়শিবিরে খুনোখুনির ঘটনা বৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বিগ্ন মানবিক সেবার দেশি ও বিদেশি সংস্থাগুলোর অন্তত ৩০ হাজার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক। নিরাপত্তাহীনতায় তাঁদের অনেকে আশ্রয়শিবিরে যাতায়াত বন্ধ কিংবা সীমিত করেছেন। কেউ কেউ বিকেল চারটার আগেভাগেই আশ্রয়শিবির ত্যাগ করছেন।

এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আশ্রয়শিবিরের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাই চিন্তিত। কারা খুনোখুনিতে জড়িত, কেন হচ্ছে, তা সবারই জানা বিষয়। আশ্রয়শিবিরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁরা প্রতিনিয়ত কথা বলছেন, বৈঠক করছেন। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.