- পুড়েছে তিনটি বড় মার্কেট ও একটি ওষুধ কারখানা
- রংপুর নগরীর মতি প্লাজা মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত
- রক্ষা পেল সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কদমতলী ফল বাজার ঈদের আগে তীব্র তাপদাহের মধ্যে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২২টি স্থানে আগুন লেগেছে। এর মধ্যে রয়েছে বড় তিনটি মার্কেট, একটি ওষুধ কারখানা । এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মানহীন বৈদ্যুতিক উপকরণ ব্যবহারও অগ্নিকাণ্ডের একটি বড় কারণ।
ঢাকার উত্তরায় বিজিবি মার্কেট ও বায়তুল মোকাররমে স্বর্ণের মার্কেটে বৈদ্যুতিক লাইনে আগুন লাগে। তবে এসব ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। শর্ট সার্কিট থেকে বিজিবি মার্কেটের আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে বিজিবির টিনশেড মার্কেটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিটের প্রচেষ্টায় তা ১১টা ২৫ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে।উত্তরার নর্থ টাওয়ার ও সাইদগ্র্যান্ড সেন্টারের মাঝামাঝি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে অবস্থিত বিজিবি মার্কেট। মোটরসাইকেল ও গাড়ির যন্ত্রাংশের মার্কেট হিসেবে এটি পরিচিত। সেখানে অন্তত ৬৫টি দোকান রয়েছে। মার্কেটের বিভিন্ন দোকান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছিল। ব্যবসায়ীরা তাড়াহুড়া করে মালপত্র বের করে নিচ্ছিলেন। ফায়ার ইনভেস্টিগেটর ও বাংলাদেশ গ্রিন ব্লিডিং একাডেমির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আল ইমরান হোসেন বলেন, দেশের অধিকাংশ বাসাবাড়ি ও বাণিজ্যিক ভবনে সিঙ্গেল লেয়ারের মানহীন বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়, যেখানে প্রয়োজন ডাবল লেয়ারের তার। অধিকাংশ ভবনে নিম্নমানের সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে ব্যবহার করা তার অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক আলোর লোড নিতে পারবে কিনা, অনেকে জানেন না। বাসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা– কোনো প্রতিষ্ঠান তা দেখভাল করছে না। এসব নজরদারির অভাবে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। পুলিশের উত্তরা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বিজিবি মার্কেটের একটি মোটর পার্টসের দোকান থেকে আগুন লাগে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। আগুনে ছয় থেকে সাতটি দোকান পুড়ে গেছে। কেউ হতাহত হননি।
মার্কেটে গাড়ির সিট ও কাভারের দোকানের মালিক মো. ইয়াসিন বলেন, ‘আগুন লাগার পরপরই কোনো রকমে দোকানের কিছু মালপত্র বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। বাকি মালপত্র পুড়ে গেছে। ঈদ উপলক্ষে কয়েক লাখ টাকার মালপত্র তুলেছিলাম। এখন সব শেষ! আগুন সব কেড়ে নিয়েছে।’
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানান, সোমবার দুপুর ২টা ৫৩ মিনিটে তাঁরা বায়তুল মোকাররমে স্বর্ণের মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় বিদ্যুতের লাইনে আগুন লাগার খবর পান। এর পর তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই ব্যবসায়ীরা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় আগুন লাগার যেসব কল তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এসেছে, তার মধ্যে ২১টি জায়গায় ফায়ারকর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ করেছেন। তার মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার ৪টি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব আগুনে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। গতকাল সকাল সোয়া ৯টার দিকে খিলক্ষেতের লেকসিটি এলাকায় একটি টিনশেড বাড়িতে আগুন লাগে। এ ছাড়া ঢাকা কলেজের বিপরীত দিকে নূর ম্যানশনের পাশে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে সন্ধ্যায় আগুন লাগে। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পৌঁছার আগেই তা নিভে যায়।
রাজধানীর বাইরে রংপুর নগরীর মতি প্লাজা মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ওই মার্কেটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের মোট ১০টি ইউনিটের ১ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। মতি প্লাজার ব্যবসায়ীরা জানান, মার্কেটে কয়েকটি গুদামসহ ৩২টি দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি দোকানের ক্ষতি হয়েছে। দ্বিতীয় তলার একটি জেনারেটরের বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত।
প্রত্যক্ষদর্শী বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমি দোকানে বসে আছি। হঠাৎ দেখতে পেলাম– ধোঁয়া বের হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, রান্নার ধোঁয়া। কিন্তু পরে যখন কালো ধোঁয়া বের হওয়া শুরু করল, তখন বুঝতে পারলাম, মার্কেটে আগুন লেগেছে। এর পর ফায়ার সার্ভিসে ফোন দিই।’ মতি প্লাজার কাপড় ব্যবসায়ী সামি উন নাহার সামি বলেন, ঈদের আগে বেচাকেনা ভালোই চলছিল। ঈদ ঘিরে বাজার জমে উঠেছে। আগুন যে জায়গায় লেগেছে, ফায়ার সার্ভিস সেই জায়গা শনাক্ত করতে পারায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি।
রংপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আব্দুল হামিদ বলেন, অগ্নিকাণ্ডে বেশকিছু দোকানের কাপড়সহ অন্য জিনিসপত্র পুড়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় ও আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। নারায়ণগঞ্জের ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড নামে একটি স্যালাইন তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে দুপুর পৌনে ১টার দিকে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিটের চেষ্টায় ১টা ৪৮ মিনিটে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় আহত চার শ্রমিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কদমতলী ফল বাজারেও গতকাল আগুন লাগে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আগুনের সূত্রপাত। তবে আধাঘণ্টার মধ্যে আগুন নেভাতে সক্ষম হয় দমকল বাহিনী। দ্রুততম সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পায় সিলেটের প্রধান ফল মার্কেটটি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগুন লাগার পর আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে ফেলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যারট নিচে ফেলায় আগুন তেমন ছড়াতে পারেনি। কদমতলী ফল মার্কেটের ব্যবসায়ী রাজেশ রায় জানান, এ ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চলে আসায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। দক্ষিণ ফায়ার স্টেশনের স্টেশন অফিসার আলাউদ্দিন মনির জানান, তাঁদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে ফল মার্কেটে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রায় আধাঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে কী কারণে আগুন লেগেছে, সেটি এখনও তদন্তাধীন।
ঈদের আগে কয়েক দিন ধরে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ঘটছে বিভিন্ন মার্কেট আর বিপণিবিতানে। ৪ এপ্রিল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ঢাকার বঙ্গবাজার। ১১ এপ্রিল চকবাজারের সিরামিক গুদামে আগুন লাগে। বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডে আগুন লেগে পুড়ে যায় ২০টি গুদাম। শনিবার ভোরে আগুন লাগে ঢাকা নিউমার্কেটের পাশে নিউ সুপারমার্কেটে। এতে পুড়ে যায় আড়াই শতাধিক দোকান। এসব ঘটনায় প্রাণহানি না হলেও ঈদের আগে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বারবার অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কোনো নাশকতা আছে কিনা– সেই প্রশ্ন উঠছে। [প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সিলেট ও রংপুর ব্যুরো এবং রূপগঞ্জ প্রতিনিধি]