১৩ লাখ টন আমদানি, ফলন ভালো, তবু বাড়ছে চালের দাম

0
42
খুচরা দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের চাল

দেশে গত এক বছরে ১৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো চাল আমদানি হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু এতে চালের দাম কমেনি, বরং বাড়ছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে মোটা চালের সর্বনিম্ন দর উঠেছে প্রতি কেজি ৫৫ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ৫০ টাকা। মাঝারি চালের কেজি ৬০-৬৫ টাকা। সরু চাল কিনতে লাগছে প্রতি কেজি ৭৫-৮৫ টাকা।

চালের এই মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয় মূলত ২০২০ সালের শুরু থেকে। তখন প্রতি কেজি মোটা চালের দর ছিল ৩০-৩৫ টাকা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার নানা পদক্ষেপের কথা বলেও চালের দাম কমাতে পারেনি। এখনো সেটা কমছে না।

চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব সবচেয়ে বেশি হয়। আর দরিদ্র পরিবারে ব্যয়ের বড় একটি খাত হলো চাল কেনা।

রাজধানীর কাজীপাড়ার মোসলেম উদ্দিনের দোকানে গতকাল রোববার নিত্যপণ্য কিনছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা তানিয়া বেগম। তিনি বলেন, তাঁর পরিবারে প্রতি মাসে মিনিকেট চালের ২৫ কেজির একটি বস্তা কেনা হয়। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে এক বস্তা চাল ২ হাজার ১৫০ টাকায় নিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে সেই একই চালের বস্তা নিয়েছেন ২ হাজার ৩০০ টাকায়। বেশি পড়েছে কেজিপ্রতি ৬ টাকা।

তানিয়া বলেন, সংসারের খরচ নিত্য বাড়ছে। অথচ বেতন কিন্তু বাড়ছে না। এভাবে দাম বাড়লে সংসারে চালাবেন কী করে, প্রশ্ন তাঁর।

ঢাকায় চালের দাম

বোরো মৌসুমে দেশে দুই কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদিত হয়, যা সারা বছরের মোট উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি। বোরোর ভরা মৌসুমে সাধারণত চালের দাম অনেকটাই কমে যায়। এবার কিছুটা কমেছে। তবে মোটা চালের কেজি ৫০ টাকা বা বেশি ছিল।

সাধারণত মে মাস পর্যন্ত বোরো মৌসুম ধরা হয়। এবার দেখা গেছে, জুনেই চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। টিসিবির হিসাবে, মোটা চালের কেজি যেমন ৫ টাকা বেড়েছে, তেমনি মাঝারি চালের দর কেজিপ্রতি ৩-৭ টাকা এবং সরু চাল ৩-৫ টাকা বেড়েছে।

তানিয়া বলেন, সংসারের খরচ নিত্য বাড়ছে। অথচ বেতন কিন্তু বাড়ছে না। এভাবে দাম বাড়লে সংসারে চালাবেন কী করে, প্রশ্ন তাঁর।

৫৫ টাকা কেজিতে যে মোটা চাল বিক্রি হয়, তা সাধারণত সব বাজারে পাওয়া যায় না। নিম্ন আয়ের মানুষকে চাল কিনতে হয় মূলত ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে। রাজধানীর কাজীপাড়ার বাইশবাড়ী এলাকা ও পশ্চিম তেজতুরী বাজারের মুদিদোকান এবং কারওয়ান বাজারের আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, মানভেদে পাইজাম চাল ৬০-৬২ টাকা এবং বিআর আটাশ ৬০-৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। এই চালই মূলত নিম্নবিত্তের মানুষেরা কেনেন।

কাজীপাড়ার বাইশবাড়ী জেনারেল স্টোরের মালিক মোসলেম উদ্দিন বলেন, তিনি মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল বিক্রি করেন। ১৫ দিন আগে মিনিকেট চালের ৫০ কেজির বস্তা ৩ হাজার ৮০০ টাকায় কিনেছেন। গত শুক্রবার তা কিনেছেন ৪ হাজার ১০০ টাকায়। তাই তাঁকেও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

আমদানি ১৩ লাখ টন

দেশে গত আগস্টে বন্যায় আমনের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন সরকার শুল্ক কমানো ও ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৩ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে এসেছে ৮ লাখ ৩৫ হাজার টন। বেসরকারি আমদানিকারকেরা এনেছেন প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার টন চাল। একই সময়ে ৬২ লাখ টন গমও আমদানি হয়েছে।

সরকারের কাছে এখন খাদ্যশস্য মজুত আছে প্রায় ১৮ লাখ টন, যা সন্তোষজনক বলে গণ্য করা হয়। এর মধ্যে ১৫ লাখ টনের বেশি চাল।

সাধারণত মে মাস পর্যন্ত বোরো মৌসুম ধরা হয়। এবার দেখা গেছে, জুনেই চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। টিসিবির হিসাবে, মোটা চালের কেজি যেমন ৫ টাকা বেড়েছে, তেমনি মাঝারি চালের দর কেজিপ্রতি ৩-৭ টাকা এবং সরু চাল ৩-৫ টাকা বেড়েছে।

বিশ্ববাজারে দাম কমেছে

বিশ্ববাজারে চালের দাম কমেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে থাইল্যান্ড ৫ শতাংশ ভাঙা চালের প্রতি টনের গড় দাম ছিল ৫৮৬ ডলার, যা গত মাস জুনে নেমেছে ৪১৯ ডলারে। ভিয়েতনামের চাল ৫৪৩ ডলার থেকে কমে নেমেছে ৩৭৭ ডলারে। গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় চালের দাম কম।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে চাল আমদানি সাধারণত নিষিদ্ধ থাকে। সরকার বিশেষ অনুমতি দিয়ে চাল আমদানি করে। বিশেষ অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। শুল্কছাড়ের মেয়াদও শেষ। এ কারণে চাল আমদানি হচ্ছে না। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্কহার অনুযায়ী, চাল আমদানিতে মোট শুল্ক–কর এখন সাড়ে ৬৭ শতাংশ।

বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ১৫ এপ্রিলের পর চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব আমদানিকারক অনুমতি পেয়েছিলেন, তাঁদের ওই সময়ের মধ্যে আমদানির জন্য বলা হয়েছিল। শুল্কছাড়ও উঠে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভারতীয় চাল আমদানি হয় মূলত বর্ধমান থেকে। সেখানে প্রতি কেজির দর ৩৪ রুপি। বাংলাদেশে আনতে কেজি পড়বে ৫৩-৫৪ টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে চাল আমদানি সাধারণত নিষিদ্ধ থাকে। সরকার বিশেষ অনুমতি দিয়ে চাল আমদানি করে। বিশেষ অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। শুল্কছাড়ের মেয়াদও শেষ। এ কারণে চাল আমদানি হচ্ছে না। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

করণীয় কী

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২২ সালের পর ডলারের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। ফলে দেশি চাল ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের বাজার সুরক্ষা পেয়েছেন। বিদেশ থেকে চাল আমদানির খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে দেশীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে না। বড় ব্যবসায়ীরা বিপুল বিনিয়োগ করে ধান-চাল কিনে রাখছেন। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সংস্থার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি মুনাফার সুযোগ দেখতে পান, সেখানে বিনিয়োগ করবেন, ধান-চাল মজুত করবেন; এটা থামানো যাবে না। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুল্ক–কর তুলে নিয়ে চাল আমদানি অবাধ করে দিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার তিন মাসের জন্য শুল্ক–কর তুলে নিয়ে আমদানি উন্মুক্ত করে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা দেখতে পারে।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে ঋণপ্রবাহ কমানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। তবে তা এখনো চড়া, ৯ শতাংশের বেশি (মে, ২০২৫)। অন্যদিকে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য কম থাকায় কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ কম।

চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে ক্ষেত্রে ঠিক সময় আমদানি করতে হবে, যাতে চাহিদাজনিত চাপ চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। সরবরাহ ঠিক থাকার কারণে এবার রোজার সময় অনেক পণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। সরকারের সেই চেষ্টা সামগ্রিকভাবে সারা বছর ধরে দেখা যাচ্ছে না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু মুদ্রানীতির ওপর জোর দিয়েছে। তাতে হবে না। বাজার ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঠিকমতো আছে কি না, সেই দিক খেয়াল রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন যদি যথেষ্ট না হয়, সঠিক সময় আমদানিটা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশে মূল্যস্ফীতি মূলত সরবরাহ–সংকটের কারণে উল্লেখ করে সেলিম রায়হান বলেন, চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে ক্ষেত্রে ঠিক সময় আমদানি করতে হবে, যাতে চাহিদাজনিত চাপ চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। সরবরাহ ঠিক থাকার কারণে এবার রোজার সময় অনেক পণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। সরকারের সেই চেষ্টা সামগ্রিকভাবে সারা বছর ধরে দেখা যাচ্ছে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.