হিমালয়ের দুর্গম পথে একা হাঁটছেন এই বাংলাদেশি, শুনুন তাঁর এক দিনের অভিজ্ঞতা

0
210
হিমালয়ের দুর্গম পথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার কঠিন অভিযানে নেমেছেন ইকরামুল হাসানছবি: লেখকের সৌজন্যে

হিমালয় পর্বতমালার মধ্য দিয়ে নেপালের পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যাওয়া পথটিই ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’। দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। দুর্গম এই পথই হেঁটে পাড়ি দেওয়ার কঠিন অভিযানে নেমেছেন ইকরামুল হাসান। ভিসার মেয়াদ আর অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় দুই-তৃতীয়াংশ পথ পাড়ি দিয়েই তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। অর্থের সংস্থান হয়ে গেলেই আবার শুরু হবে অভিযান। পেরিয়ে আসা পথটা কেমন ছিল? এক দিনের বর্ণনায় তারই আভাস

অভিযানে তাঁবুই ঠিকানা

অভিযানে তাঁবুই ঠিকানা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ভয় বেড়েই চলেছে। নিঃশব্দে ধীরে ধীরে উঠে বসি। অন্ধকারে হেডটর্চটা খুঁজতে থাকি। বদলে হাতে ঠেকে পানির বোতল। অন্ধকারের মধ্যেই ছিপি খুলে পানি খাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। জমে বরফ হয়ে আছে পানি। আবার হেডটর্চটা খুঁজতে লাগলাম। শেষে নিজের মাথাতেই টর্চটা খুঁজে পেলাম। ঘুমানোর আগে টর্চটা যে মাথায় লাগিয়েছিলাম, আর খোলা হয়নি। টর্চটা কি জ্বালাব? শেষে না জ্বালিয়েই রুকস্যাকের পকেট থেকে সুইস নাইফটি বের করে হাতে নিলাম। এরপর আস্তে আস্তে তাঁবুর জিপার সামান্য খুলে দেখার চেষ্টা করলাম। কোনো প্রাণী চোখে পড়ল না। অন্ধকারে বেশি দূর স্পষ্ট দেখাও গেল না। তাঁবুর জিপার আরেকটু খুলে মাথাটা বের করে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর পেছন থেকে বড় দেহের প্রাণীটি দৌড়ে দূরে সরে গেল। মুহূর্তের মধ্যে মাথাটা তাঁবুর ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললাম। ভয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ। নিজেকে বোঝালাম এখানে মৃত্যুর থেকে বড় কিছু হওয়ার নেই। আর আমাকে মেরে ফেলবে, এমন কোনো প্রাণী থাকার কথাও না। সাহস করে আবার মাথাটা বের করলাম। দেখতে পেলাম তাঁবু থেকে ২০-২৫ মিটার দূরে সাদা রঙের কয়েকটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। টর্চের পাওয়ার বাড়িয়ে ভালো করে দেখার
চেষ্টা করলাম। বড় তিনটি ঘোড়ার সঙ্গে ছোট্ট একটা বাচ্চা।

একটুখানি বিরতি

একটুখানি বিরতি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ভয় কেটে গেল। পকেট থেকে চকলেট বের করে মুখে নিয়ে ভাবতে লাগলাম, এই জীবনে এর চেয়ে বেশি ভয় কি কখনো পেয়েছি? মনে করতে পারলাম না। আজ ২৩ দিন ধরে দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইলে টানা ট্রেকিং করছি। শুরুটা করেছি নেপালের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তিব্বত সীমান্তবর্তী হিলশায়। এই কয়েক দিনে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছি। কখনো স্থানীয় বাসিন্দাদের কুঁড়েঘরে, কখনো জঙ্গলে তাঁবু ফেলে থাকতে হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র দুই দিন বিশ্রাম নিয়েছি।

শরীর যে খুব বেশি ক্লান্ত তা কিন্তু নয়। এখন রাত কয়টা বাজে? সকাল হতে কত দেরি? হাতে কোনো ঘড়ি নেই। স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে মুঠোফোনটা বের করে পাওয়ার বাটন চেপে অন করলাম। ১২টা ২১। ভোর হতে অনেক বাকি। ঘুম আর আসছে না। মুঠোফোনে মায়ের ছবিটা বের করে দেখলাম। চোখ থেকে জল গড়িয়ে কান অবধি আসার আগেই মুছে নিলাম। গাজীপুরে আমার মা–ও হয়তো আমার চিন্তায় রাত জেগে আছে। হয়তো সে–ও আঁচলে চোখ মুছছে।

এখানে তাপমাত্রা হুটহাট হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়

এখানে তাপমাত্রা হুটহাট হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়
ছবি: সংগৃহীত

দিনের আলোয়

সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি। কয়েক দিন ধরেই টানা বৃষ্টি আর তুষার। হুটহাট তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাচ্ছে। একটু পরপরই চারপাশ ঢেকে অন্ধকার করে দিচ্ছে মেঘ। গ্রাম থেকে যেদিন বেরিয়ে আসি, সেদিন কয়েকটি রুটি এনেছিলাম। সেই রুটিই গত তিন দিন একটা করে দুপুরে খেয়েছি। একটা রুটি ছিল, পানি দিয়ে ভিজিয়ে সকালে খেয়েছি।

বৃষ্টির মধ্যেই ট্রেকিং শুরু করি। ওপর থেকে একটা পাহাড়ি ছোট নদী নেমে এসেছে। এখানে এই ছোট নদীগুলোকে বলে খোলা। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এই খরস্রোতা নদীর পানি কলকল শব্দে বয়ে চলেছে। পাড় ধরে ওপর দিকে এগিয়ে চলছি। যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই, তাই নিজের মতো করেই পথ তৈরি করতে হচ্ছে। ওপর থেকে কাদাপানি নেমে আসছে দেখে দ্রুত জায়গাটা পার করে এসে দাঁড়িয়ে একটু দম নিই। রুকস্যাকটা বড় একটা গাছের গোড়ায় রেখে পানির বোতলটা হাতে নিয়েছি মাত্র, হঠাৎ বিকট শব্দ। বিশাল একটা গাছ ভেঙে পড়ল। মাত্রই ওই জায়গাটা পেরিয়ে এসেছি। রুকস্যাক ফেলেই দৌড়ে দূরে সরে গেলাম। মুহূর্তের মধ্যে পাহাড় ধস হয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে নিচে নেমে গেল। অল্পের জন্য রক্ষা। মনে হলো নতুন জীবন পেলাম।

এমন দুর্গম পথেও হাঁটতে হয়েছে

এমন দুর্গম পথেও হাঁটতে হয়েছে 
ছবি: সংগৃহীত

ঘন জঙ্গলের ভেতরে কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো গাছের শিকড়বাকড় ধরে ওপরের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। চড়াই ওঠার সময় হাতের বেশ কয়েক জায়গায় কাঁটা বিঁধে কেটে গেছে। একটা শিকড় ধরে উঠতে গিয়ে ছিঁড়ে ধপাস করে ১৫–২০ ফুট নিচে স্যাঁতসেঁতে কাদার মধ্যে চিতপটাং হয়ে পড়ে গেলাম। এর মধ্যে গায়ে গোটা দশেক জোঁক কামড়ে ধরেছে। বুটজোড়া কাঁধে ঝুলিয়ে বেশ কয়েকটি ঝিরিও পার হতে হয়েছে। এভাবেই বিকেল চারটা নাগাদ ট্রেকিং করে টাকলাখোলা পৌঁছাই। সারা দিন বৃষ্টিভেজা হয়ে দিনের আলো থাকতে থাকতেই জঙ্গলের ভেতরে তাঁবু খাটিয়ে ফেলি। ভেজা কাপড় ছেড়ে কাঁপতে কাঁপতে কিছু শুকনো ডালপালা এনে আগুন জ্বালাই। শুকনো ডালপালা কুড়াতে গিয়ে বেশ কিছু মাশরুম দেখেছিলাম, সেগুলো আনার জন্য আবার গেলাম। ফিরে এসে দেখি তাঁবুর চারপাশে ঘুরঘুর করছে একদল বানর। ঢিল ছুড়ে আর লাঠি দেখিয়ে ওদের তাড়ালাম। আগুনের পাশে পাথরের ওপরে ছোট প্যাকেটে কয়েকটি খেজুর ছিল, সেগুলো ওরা নিয়ে গেছে। পাশের পাহাড়ি ঝিরি থেকে পানি এনে মাশরুমগুলো ভালো করে ধুয়ে নিলাম। একমুঠো চালের সঙ্গে মাশরুম দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। সন্ধ্যায় কিছু সময় আগুনের পাশে বসে ভেজা কাপড়, মোজা ও বুটজোড়া শুকিয়ে নিলাম।

ইকরামুল হাসান

ইকরামুল হাসান
ছবি: সংগৃহীত

হাজারো ভালো-মন্দ ভাবতে ভাবতে রাতটা কেটে গেল।

ভোরের আলো ফুটতেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলাম। চারপাশটা এত সুন্দর, গতকাল ভালো করে খেয়াল করিনি। ঝিঁঝি আর পাখিরা আপন তালে ডেকেই চলেছে। এখন সামান্যতম বাতাস নেই। মনে হচ্ছে কোনো এক অজানা শোকে গাছেরা যেন নীরবতা পালন করছে। তাদের কিসের শোক আমার জানা নেই। আমার শুধু জানা আছে সামনে এগোতে হবে। এখনো অনেক পথ বাকি…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.