হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে উষ্ণ হচ্ছে পাকিস্তানের সম্পর্ক

আল জাজিরার প্রতিবেদন

0
5
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকেই বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন বড় ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কেও। বিশেষ করে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অবনমনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি দারুণভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে।
 
সম্প্রতি দুই দেশের সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছরের মধ্যে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের এতটা উষ্ণতা আগে দেখা যায়নি কখনও। খবর আল জাজিরার।
 
গত মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসানের। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) আইএসপিআরের বিবৃতি অনুসারে, পাকিস্তানের রাজধানীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের এ সফরটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উচ্চতার স্বাক্ষর বহন করে। বৈঠকে দুদেশের কর্মকর্তা এই মর্মে একমত হয়েছেন যে, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান ভাতৃপ্রতিম দেশ এবং বহিঃশক্তির প্রভাব থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্ক অবশ্যই দৃঢ় থাকবে।
 
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হচ্ছে; কারণ রাজনীতির মাঠে দুই দেশের মধ্যেই ভারত বিরোধিতা রয়েছে। মুনির ও কামরুল হাসানের বৈঠকটি ছিল দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠকের অংশ।
 
আইএসপিআরের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বৈঠকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের সেনাবাহিনীর পারস্পরিক আদান-প্রদান, সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের মাত্রা বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশের পিএসওর মধ্যে।
 
সেখানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান বলেছেন, দুই দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর মধ্যকার সহযোগিতাপূর্ণ বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপের মাধ্যমেই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নিরাপত্তা ও সীমান্ত সুরক্ষা সম্ভব এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও অংশীদারত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপমহাদেশের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার জন্য খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
 
তখন বাংলাদেশের পিএসও লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামর-উল-হাসান পাকিস্তানের সেনাবাহনীর পেশাদারিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ দমনের লড়াইয়ে ব্যাপক আত্মদানের মাধ্যমে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নিজেকে সাহস এবং দৃঢ় সংকল্পের বাতিঘরে পরিণত করেছে।
 
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের এ বৈঠক ছাড়াও গত ৫ আগস্টের পর আরও একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় দুদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। গত মাসে মিশরের রাজধানী কায়রোত অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া এই দুই নেতার মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে সাক্ষাৎ হয়।
 
এছাড়া পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগামী মাসে বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১২ সালের পর এটিই হবে পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। এই বিষয়গুলো দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
 
মূলত, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা ও ইসলামাবাদের বৈরিতার শুরু হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং আল-বদর ও আলশামসসহ তাদের সহযোগী মিলিশিয়ারা স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে নিধনযজ্ঞে নামে। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। অন্তত দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল।
 
ওই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এতে সহায়তা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পরে শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন এবং ‘জাতির পিতা’ উপাধি পান।
 
পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করলেও ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে বিভিন্ন অমীমাংসিত বিষয় থেকে যায়। এর মধ্যে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়া, পাকিস্তানি পরিচয় দেয়া উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে না নেয়া এবং ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী সম্পদের ভাগাভাগি অন্যতম।
 
আর এই অমিমাংসিত বিষয় নিয়ে কায়রোতে শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে কথা বলেন ড. ইউনূস। জবাবে শাহবাজ শরিফ বলেন, ১৯৭৪ সালেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে বিষয়গুলো মীমাংসা হয়ে গেছে। তবে যদি আরও অমীমাংসিত ইস্যু থাকে, তাহলে সেগুলোতে খুশি মনেই মনোযোগ দেবেন তিনি।
 
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের সাম্প্রতিক উষ্ণতা নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ কোরেশি আল-জাজিরাকে বলেন, নয়াদিল্লির তরফ থেকে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারকে দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করার কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, সম্ভবত এই বিষয়টি ঢাকা প্রশাসনকে নতুন করে কৌশল নির্ধারণে উদ্বুদ্ধ করেছে।
 
অবশ্য কিংস কলেজ লন্ডনের সিনিয়র লেকচারার ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ও সামরিক চালাচালিকে ‘অতিরঞ্জিত’ করে দেখা হচ্ছে বলে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিয়েছে- এটি অবশ্যই লক্ষ্য করার মতো একটি প্রবণতা। তবে এটি তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যখন এর সঙ্গে ব্যাপক নীতিগত পরিবর্তন যুক্ত হবে। এর আগে আমরা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারি না।
 
প্রসঙ্গত, ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনমালে গত ১৫ বছর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক খুবই সীমিত ছিল। এর প্রভাব পড়েছিল দুদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যেও। কিন্তু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। পরবর্তীতে ৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার মাধ্যমে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে জোরদার হতে থাকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের মধ্যে কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। পাশাপাশি দুদেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলও একাত্তরের পর ফের শুরু হয়েছে।
 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.