হালদায় নমুনা ডিম ছাড়ছে মা মাছ, তীব্র দাবদাহে এবার ডিম ছাড়তে দেরি

0
89
প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতে নমুনা ডিম ছেড়েছে মা মাছ।বুধবার রাতে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মাছুয়াগোনা এলাকায়

দেশের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে চার থেকে পাঁচটি স্থানে কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউস) মা মাছেরা নমুনা ডিম ছাড়া শুরু করেছে। গতকাল বুধবার রাতে জোয়ারের সময় রাত সাড়ে ১১টায় এবং ভাটার সময় রাত ৩টার দিকে হালদা নদীর হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের রামদাসমুন্সির হাট, মাছুয়াঘোনা, আমতুয়া ও গড়দোয়ারা ইউনিয়নের নয়াহাট এলাকায় বেশ কিছু নমুনা ডিম পেয়েছেন সংগ্রহকারীরা।

তবে এবার বেশ দেরি করেই ডিম ছাড়া শুরু করেছে মা মাছেরা। অন্যান্য বার এপ্রিলের শুরু ও মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে একাধিকবার ডিম ছাড়ে মা মাছ। কিন্তু এবার তীব্র দাবদাহ ও ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে হালদা নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ডিম ছাড়তে দেরি হচ্ছে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ শাহিদুল আলম বলেন, গতকাল বুধবার রাতে তাঁর উপজেলার দুই থেকে তিনটি স্থানে মা মাছের নমুনা ডিম ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন। তবে তা খুবই কম।

মৎস্য গবেষকদের ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে এবার তাপমাত্রা বাড়ার আগের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। এত তাপমাত্রায় মানুষের মতো নদীতে মাছও অতিষ্ঠ হয়ে যায়। এ নদীর কার্পজাতীয় মা মাছেরা ডিম দেওয়ার জন্য বজ্রসহ বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের জন্য অপেক্ষা করে। এবার প্রজনন মৌসুমের দেড় মাসজুড়েই এসবের কিছুই ঘটেনি। ফলে মা মাছেরা এত দিন ডিম ছাড়তে পারেনি। তবে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবের পর গত কয়েক দিনের বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টির কারণে নদীর লবণাক্ততার পরিমাণ এখন স্বাভাবিক হয়েছে।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার আগে-পরে তীব্র দাবদাহে নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। যার কারণে এবার নমুনা ডিম ছাড়তে দেরি করেছে মা মাছ। এখন অবশ্য বৃষ্টি হওয়ায় লবণাক্ততার পরিমাণ কমে স্বাভাবিক হয়েছে। ডিম ছাড়ার জন্য মা মাছের যে ধরনের পরিবেশ দরকার, তা এখন আছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ অ্যান্ড ল্যাবরেটরি, হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রজনন মৌসুমে হালদা নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতি লিটারে সাড়ে ৩ হাজার মিলিগ্রাম। যা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে ২০ থেকে ৩০ মিলিগ্রাম। যেহেতু কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, আর নদীতেও জো (ডিম ছাড়ার মৌসুম) চলছে, তাই দুই-এক দিন নমুনা ডিম ছাড়া চালু থাকবে। এটা চলতে চলতে বজ্রবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পরিমাণ আরও বাড়লে পুরোদমে মা মাছ ডিম ছাড়া শুরু করবে।

ডিম সংগ্রহকারী মুহাম্মদ শফি ও কামাল সওদাগর বলেন, হাটহাজারীর রামদাস মুন্সিরহাট, মাছুয়াঘোনা, নাপিতের ঘাট, আমতুয়া, নয়াহাট, রাউজানের আজিমের ঘাট এলাকায় কিছু ডিম পাওয়া গেছে। এগুলো নমুনা ডিম। পুরোদমে ডিম ছাড়ার আগে এ রকম নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ। কয়েক দিন থেকে বৃষ্টি অব্যাহত আছে। সঙ্গে পাহাড়ি ঢল হলে মা মাছেরা পুরোদমে ডিম ছাড়া শুরু করবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ অ্যান্ড ল্যাবরেটরির তথ্যমতে, হালদা নদীতে গতবার মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কেজি। এর আগে ২০২১ সালে ৮ হাজার ৫০০ কেজি। ২০২০ সালে নদীতে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ২৫ হাজার কেজি, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড করা ছিল।

হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ার মৌসুম ঘিরে দুই পাড়ে প্রতিবছর ৪০০ থেকে ৫০০ নৌকায় ৭০০ থেকে ৮০০ ডিম সংগ্রহকারী মা মাছের নিষিক্ত ডিম ধরার অপেক্ষায় থাকেন। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে গত দুই বছর ডিমের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় ডিম সংগ্রহকারীর সংখ্যা কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ডিম সংগ্রহকারীদের সহযোগিতা করতে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নদীতে কাজ করছেন দুই উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

জেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এপ্রিল থেকে জুন মাস হালদা নদীতে কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম ছাড়ার সময়। যা দেশের অন্যান্য নদীতে হয় না। এ কারণে হালদা নদী দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। এ নদীর ১০ কিলোমিটার এলাকায় নৌ পুলিশ ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা দিয়ে অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে পর্যবেক্ষণ করে। পাশাপাশি রেণু পোনা ফোটানো হ্যাচারিতেও সিসিটিভি ক্যামেরা আওতায় এনে ডিম সংগ্রহ ও রেণু উৎপাদন কার্যক্রম তদারকি করা হয়।

সম্প্রতি নদী এলাকা ঘুরে জানা যায়, চলতি মাসের শুরু থেকে পূর্ণ প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ায় নদীতে অপেক্ষায় আছেন ডিম সংগ্রহকারী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখন নদীতে প্রচুর মা মাছের আনাগোনা লক্ষ করা যাচ্ছে। কয়েক দিন ধরে বজ্রপাতসহ ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে পাহাড়ি ঢল নামলে নদীতে মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়া শুরু করবে। ডিম উৎসবের অপেক্ষায় দুটি উপজেলার চারটি সরকারি হ্যাচারি ও শতাধিক মাটির কুয়ায় রেণু পোনা ফোটানোর জন্য নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, এখন নদীতে জোয়ের মৌসুম চলছে। আরও চার থেকে পাঁচ দিন সেটি চলবে। এর মধ্যে বজ্রসহ বৃষ্টিও চলছে কয়েক দিন ধরে। আশা করা হচ্ছে, দুই-এক দিনের মধ্যে মা মাছেরা পুরোদমে ডিম দেবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.