শিলং শহরের প্রাণকেন্দ্রে জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে গিয়ে খানিকটা অবাকই হতো হলো। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ১৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামটি এত সুন্দর! লাল-হলুদ গ্যালারি, সবুজ মাঠে চলছে ঘাস কাটা। বাইরের চারপাশ ঝাড়ামোছায় ব্যস্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। আবাসিক এলাকার মধ্যেই নির্মিত এই স্টেডিয়াম সেজেগুজে অপেক্ষায় রয়েছে আজ বাংলাদেশ-ভারত দুই দলকে স্বাগত জানাতে।
স্থানীয় দর্শকেরা অবশ্য স্বাগত জানাবেন না বাংলাদেশ দলকে। স্বাভাবিকভাবে স্বাগতিক ভারতের দিকেই থাকবে শিলংবাসীর যাবতীয় সমর্থন। সেই প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশকে খেলতে হবে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচ।
যে ম্যাচে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জার্সিতে মাঠে নামতে চলেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ফুটবলার হামজা চৌধুরী। কিছুদিন ধরে তাঁকে নিয়ে আলোচনাটা বাংলাদেশ ছাপিয়ে চলে গেছে এশিয়ার ফুটবলেই। হামজার উত্তর হিসেবে ভারতীয় দলেও থাকছেন কিংবদন্তি স্ট্রাইকার সুনীল ছেত্রী।
লড়াইটা অবশ্য দুই স্প্যানিশ কোচেরও। একদিকে বাংলাদেশের কোচ হাভিয়ের কাবরেরা, অন্যদিকে ভারতের কোচ মানোলো মার্কেজ। তাঁদের দেখানো ট্যাকটিকসের ওপর ম্যাচভাগ্য ঝুলে থাকবে অনেকটাই। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু এই ম্যাচটা তপু-তারিক কাজীদের জন্য বরাবরের মতোই একটু আলাদাই। হামজা আছেন বলেই শুধু নয়, প্রতিপক্ষ ভারত মানেই তো মর্যাদার লড়াই।
এই ম্যাচে বাংলাদেশকে জেতাতে মরিয়া হামজা। তাঁর মানের ফুটবলার এশিয়ার ৮০ শতাংশ জাতীয় দলেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ তাই ভাগ্যবান, হামজাকে নিয়ে মাঠে নামতে পারছে আজ। প্রথাগত রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হলেও তাঁকে মাঝমাঠে বা স্ট্রাইকারের পেছনে খেলাতে পারেন কোচ। সেখানেই হামজা খেলুন, আজ তিনিই বড় শক্তি বাংলাদেশের।
ইংল্যান্ড থেকে ১৭ মার্চ হামজা সপরিবার বাংলাদেশে আসেন। তাঁকে নিয়ে হওয়া উন্মাদনাটা মূলত আজকের ভারত ম্যাচ সামনে রেখেই। শিলংয়ে গত কয়েক দিনে অনুশীলন ভেন্যু নিয়ে নানা টানাপোড়েন, ঘাসের মাঠের ম্যাচের আগে টার্ফে অনুশীলন করতে বাধ্য হওয়া—সব ভুলে আজ বাংলাদেশ পাখির চোখ করছে জয়কেই। ভারতকে সর্বশেষ বাংলাদেশ হারাতে পেরেছিল ২৩ বছর আগে ঢাকায় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। দীর্ঘ খরা কাটিয়ে আজ জয় দিয়েই হামজার অভিষেক রাঙাতে চায় বাংলাদেশ।
শিলংয়ে বাংলাদেশ দলের আবাস পুলিশ বাজার-সংলগ্ন ভিভান্তা হোটেলে। কাল সেখানে ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে দুই দলের প্রতিনিধিরাই শুনিয়েছেন জয়ের আশাবাদ। সংবাদ সম্মেলন তো নয়, যেন সাংবাদিকদের মেলা! আজকের ম্যাচের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড পেয়েছেন ভারতের ৯২ জন সাংবাদিক, কার্ড পেয়েছেন বাংলাদেশ থেকে আবেদন করা ৪১ জন সাংবাদিকও।
জনাকীর্ণ হল ঘরে বাংলাদেশের কোচ হাভিয়ের কাবরেরা বলেন, ‘কঠিন ম্যাচ হবে। তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী এবং জিততে চাই।’ শিলংয়ে অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কিছুটা বিরক্ত হলেও কোচ বলেছেন, ‘সৌদি আরবে আমরা ক্যাম্প করেছি। যদিও শিলংয়ে এসে প্রস্তুতিতে একটু বিঘ্ন হয়েছে। তবে সেসব এখন অতীত।’
অতীতে কখনো বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে ভারত এত চিন্তায় পড়েনি। এবার পড়েছে মূলত হামজার কারণেই।
ফিফার র্যাঙ্কিংয়ে ভারত এখন ১২৬তম অবস্থানে, আর বাংলাদেশ ১৮৫। কাগজে-কলমে দুই দলের মধ্যে বড় ব্যবধান থাকলেও বাংলাদেশের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া এটা নিয়ে ভাবছেন না, ‘র্যাঙ্কিং নিয়ে চিন্তা করি না। আমাদের মনোযোগ ম্যাচ জিততে হবে। আপনি যখন বড় ভাইয়ের বিপক্ষে খেলতে যান, তখন সব সময় জিততে চাইবেন, তাই না? আমরাও সেটাই করতে চাই।’

অতীতে কখনো বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে ভারত এত চিন্তায় পড়েনি। এবার পড়েছে মূলত হামজার কারণেই। যদিও একজন ফুটবলারের পক্ষেই একটা ম্যাচ পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়, খেলাটা ১১ জনের। কিন্তু একক নৈপুণ্যে ম্যাচের ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন বড় ফুটবলাররা। হামজা সেই মানেরই একজন।
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে ভারত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে আগেই। এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বেও খেলেছে। দেশটির ঘরোয়া ফুটবলও অনেক শক্তিশালী। ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) ভারতের ফুটবলে আশীর্বাদ। অন্যদিকে বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগ আজও ভঙ্গুর। তবে চোটের কারণে এই ম্যাচে নেই ভারতের চার নিয়মিত ফুটবলার—মোহনবাগানের ডিফেন্ডার আশীষ রায়, একই দলের ফরোয়ার্ড ফরোয়ার্ড মানভির সিং, মুম্বাই সিটির ফরোয়ার্ড লালিয়ানজোয়ালা ও এফসি গোয়ার মিডফিল্ডার ব্রিসন ফার্নান্দেজ। তাঁদের অভাব আজ ভোগাতে পারে ভারতকে।
ভারতের কোচ মানোলো মার্কেজ অবশ্য দলে কে আছে, কে নেই, তা নিয়ে ভাবছেন না। বিকল্প দল তৈরি করেছেন, আর সেই দল নিয়েই ৩ পয়েন্ট চান স্বাগতিক দলের কোচ। তবে তাঁর ধারণা, বাংলাদেশও ভালো লড়াই করবে, ‘বাংলাদেশ বেশ ভালো খেলছে। একই কোচের অধীনে তারা তিন বছর ধরে আছে। আমাদের জন্য ম্যাচটা সহজ হবে না।’ কোচের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন ভারতীয় দলের অন্যতম সেন্টারব্যাক এফসি গোয়ার সন্দেশ জিঙ্গান। ‘জয়ের জন্যই নামব আমরা’—তিনি শুরুতেই বলে দিয়েছে নিজেদের লক্ষ্যটা।
তবে বাংলাদেশ চায় হামজার অভিষেকটা জয় দিয়ে রাঙাতে। ভারত থেকে জয় নিয়ে ফিরতে পারলে দেশবাসীর জন্য সেটি বড় এক ঈদ উপহারও হবে।
মাসুদ আলম, শিলং থেকে