মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের আলাদা বৈঠক

0
112

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ মিশনের সঙ্গে বৈঠকেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নিজ নিজ অবস্থানেই অনড়; নড়েনি একচুল। মার্কিন প্রতিনিধিরা নিজেদের মতামত না জানালেও চারটি বিষয়ে জানতে চান দলগুলোর কাছে।

আওয়ামী লীগ জানিয়ে দিয়েছে– সংবিধান লঙ্ঘন করে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা অসম্ভব। সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সংসদ বিলুপ্তি এবং নির্বাচন কমিশন বাতিলের মতো দাবি জানিয়ে বিএনপি সমঝোতার পথ খোলা রাখেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে বলেও প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।

অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, শেখ হাসিনার অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা হবে না।

সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) চাওয়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দলটি বলেছে, বিএনপি ভোট বর্জন করলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। অংশগ্রহণমূলক না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কিনা, বোঝা সম্ভব নয়।

গতকাল সোমবার বড় তিন দল ছাড়াও চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি এবং এবি পার্টির সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি দল বৈঠকে বসে। তারা জানতে চায়– আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা সম্ভব কিনা? আগামী তিন মাসে নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার এলে তা সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিতে সহায়ক হবে কিনা? যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠালে তা ইতিবাচক হবে কিনা? র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব আছে কিনা?

নিজেরা মন্তব্য না করে এই চার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ জানতে চায় মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। তারা এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না দিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানায়। নির্বাচনের পরিবেশ ও বাস্তবতা এবং সন্ত্রাস-সহিংসতার শঙ্কার কথাও জানতে চান পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা। কীভাবে সব দলকে নির্বাচনে আনা যায়, তাও জিজ্ঞাসা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাত সদস্যের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ মিশন গত শনিবার ঢাকায় আসে। রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বৈঠক করে তারা। আজ মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, নারী সংসদ সদস্য, আইনজীবী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দলটির বৈঠক করার কথা। আগামী শুক্রবার ঢাকা ছাড়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলবেন দলটির সদস্যরা।

ধারাবাহিক বৈঠকের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকালে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে বসে প্রতিনিধি দলটি। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নেতৃত্ব দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দুপুরে তারা রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিকেলে গুলশানের একটি হোটেলে জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিনিধি দলটি। যার নেতৃত্ব দেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

এসব বৈঠক শেষে সব দলের পক্ষেই প্রেস ব্রিফিং করে বৈঠকের আলোচনা ও দলীয় অবস্থান তুলে ধরা হয়। মার্কিন প্রতিনিধি দলটি কোনো বক্তব্য দেয়নি। তারা নিজ দেশে ফিরে গিয়ে এ-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানা গেছে।

এসব বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের পক্ষে মারিয়া চিন বিনতে আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে অংশ নিয়েছেন– মারিও মাইত্রি, জেমি ক্যানডেন্স সাপ স্পাইকারম্যান, আকাশ সিসাসাই কুলোরি, ডেনিয়েল মাইকেল রেইলি এবং জিওফ্রে পিটার ম্যাকডোনাল্ট।

আওয়ামী লীগ মনে করে, সমঝোতার পথ খোলা রাখেনি বিএনপি

বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দল বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা ও সহাবস্থানের সুযোগ আছে কিনা জানতে চেয়েছে। জবাবে আমরা বলেছি, বিএনপিই সে সুযোগ রাখেনি। বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, মৃত ইস্যু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা, নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং সংসদের বিলুপ্তি চায়। সংবিধানের বাইরে গিয়ে তো এসব করা সম্ভব নয়। এসব দাবি তুলে বিএনপিই সমঝোতার পথ বন্ধ করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, তারা এখানে কোনো বিষয়ে মধ্যস্থতা করতে আসেনি। তারা কোনো পক্ষ নিয়ে এসেছে– আমাদের কাছে এমনটাও মনে হয়নি। তাদের কথাবার্তা ইতিবাচক মনে হয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধি দলটি বিএনপির দাবি নিয়েও কোনো কথা বলেনি।
দুপুর সোয়া ১২টার কিছু পরে বৈঠক শুরু হয়ে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে। আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত।

ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দল আগামী নির্বাচনের পরিস্থিতি ও সন্ত্রাসের শঙ্কা আছে কিনা এবং এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানতে চেয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ ও বাস্তব অবস্থাও তারা পর্যবেক্ষণ করছে। তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। আমরাও বলেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে জনগণের কাছে অঙ্গীকার করেছেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারে গত ১৫ বছরে সরকারের প্রচেষ্টাও তুলে ধরেছি।

প্রতিনিধি দলটি এসব বিষয়ে কোনো প্রস্তাব দেয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র কীভাবে দেখছি– এটাও জানতে চেয়েছে। এ বিষয়ে আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি।
দেশের ৭০ শতাংশ লোক শেখ হাসিনাকে ভোট দিতে উন্মুখ– এমন কথা প্রতিনিধি দলকে বলা হয়েছে জানিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, বিএনপি যেসব অভিযোগ তাদের (মার্কিন প্রতিনিধি দল) কাছে করেছে, আমরা এর জবাব দিয়েছি। বিএনপি মিথ্যাচার ও আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে। এগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তাদের অনুরোধ করেছি।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মার্কিন প্রতিনিধি দলকে ইতিবাচক মনে হয়েছে।

বিএনপির দাবি, ভোটের পরিবেশের আরও অবনতি হয়েছে

প্রতিনিধি দলকে বিএনপি জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কখনোই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের অবস্থা তুলে ধরে দলটি বলেছে, এবারও একই কায়দায় তারা একতরফা নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। দলীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে হয়রানি, গ্রেপ্তার, গায়েবি মামলা ও প্রহসনের বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে, যা আগামীতে আরও অনেক গুণ বাড়বে।

গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দেড় ঘণ্টার বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে বিএনপি তার পর্যবেক্ষণ ও দাবি তুলে ধরার পাশাপাশি ‘তথ্য-প্রমাণ’ দেয়। সেখানে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে বাধা, বিগত নির্বাচনের প্রতিবেদন, নির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তা এমনকি বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে দেওয়া বক্তব্যও তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, তাঁকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন বলে সূত্র জানায়।

বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছিল। তারা ফিরে গিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। যুক্তরাষ্ট্রও নির্বাচনের পরিবেশ ও আগামী দিনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা, জানতে এসেছে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছি– শেখ হাসিনার অধীনে কোনোভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিগত দুই নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অবস্থার পরিবর্তন হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে। সরকার বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং লুটেরা ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে ভোট চুরির প্রকল্প করেছে। এখান থেকে মুক্ত হতে হলে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, সংসদ বাতিল এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার মতামতের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।

বিএনপির প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ।

নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব পেলে বিবেচনা করবে জাপা

জাপার সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি দল জানতে চায়– আগামী নির্বাচন কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক করা যায়। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, বিএনপি বর্জন করলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার আলোচনা করতে সরকারের সম্মতি প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ রাজি না থাকলে আলোচনা সফল হবে না।

বৈঠকে অংশ নেওয়া জাপার এমপি মেজর (অব.) রানা মো. সোহেল এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, মার্কিন প্রতিনিধিরা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেননি। তারা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে তাদের ভূমিকা থাকবে না। দেশে ফিরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সুপারিশ করবে।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে জি এম কাদের বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেওয়া বিষয়ে সরকার থেকে প্রস্তাব পেলে বিবেচনা করবে জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে অংশ নেব না– এমন কথা কখনও বলিনি। সামনে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেবে জাতীয় পার্টি।

তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা আছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জনে গিয়ে আন্দোলন করলে সহিংসতা হতে পারে। নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা জানতে চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান।
জি এম কাদের জানান, নির্বাচনে কোন কোন ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় এবং তা কীভাবে রোধ করা যায়, সে বিষয়ে মতামত জানতে চান মার্কিন প্রতিনিধিরা। অতীতে কখন, কীভাবে নির্বাচন হয়েছে– তাও জানতে চান। বৈঠকে আরও অংশ নেন জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাসরুর মওলা ও ভাইস চেয়ারম্যান আহসান আদেলুর রহমান এমপি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.