রাজধানীর যানজট কমাতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১১ সালে।
হাতিরঝিলের একাংশ ভরাট করা হলেও পরে তা খনন করা হবে, বলছে কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়কের উন্নয়নকাজের জন্য ভরাট করা হচ্ছে রাজধানীর হাতিরঝিলের একাংশ। উড়ালসড়কটির ৪১টি খুঁটি বা পিলার বসবে হাতিরঝিলের ইস্কাটন অংশের পাড় ঘেঁষে। এই কাজের জন্য বালু ফেলে সেখানে ভরাটকাজ চলছে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্পের ‘সোনারগাঁও লিংক’ নামে একটি র্যাম্পের (যানবাহন ওঠা-নামার পথ) নির্মাণকাজের জন্য হাতিরঝিলের একাংশে বালু ফেলা হয়েছে। অস্থায়ীভাবে লেকের কিছু অংশ ভরাট করা হয়েছে। এতে পানিপ্রবাহের কোনো ক্ষতি হবে না। কাজ শেষে আবার খনন করা হবে। অবশ্য কত দিন লেক ভরাট করে রাখা হবে, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট সময় বলতে পারেনি এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ।
গত মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, হাতিরঝিলের ইস্কাটন অংশে ভরাটের কাজ চলছিল। সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে ভেঙে ফেলা বিজিএমইএ ভবনের দিকে ভরাট বেশি। এই অংশে আর কয়েক ফুট ভরাট হলে লেকের দুই পাড় মিলে যাবে। ভরাটের কাজে ব্যবহৃত ভারী যন্ত্রপাতি সেখানেই রাখা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রকল্পের একাধিক কর্মী বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরেই ভরাটের কাজ চলছে। পিলার বসানোর কাজ শুরু হবে। কাজ শেষ হলে ভরাট করা অংশ খুলে দেওয়া হবে বলে তাঁরা শুনেছেন।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সমন্বয়কারী ও সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক মিসবাহিল মোকার রাবিন বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের অনেকগুলো র্যাম্পের একটি নামবে ইস্কাটন অংশে। সে জন্য ৪১টি পিলার বসানো হবে। পিলার বসাতে পাইলিংয়ের কাজের সুবিধার্থে লেকের কিছু অংশ ভরাট করা হচ্ছে। তিনি জানান, এক্সপ্রেসওয়ের কাজের বিষয়ে লেক দেখভালের দায়িত্বে থাকা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমতি নেওয়া হয়েছে। লেক কত দিন ভরাট থাকবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শুরু ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ হয়ে এটি যাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের মতো। পুরো পথে মোট ১৫টি ওঠার ও ১৬টি নামার জায়গা থাকবে। এর পাশাপাশি কাঁটাবন হয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত উড়ালপথে সংযোগ সড়ক থাকবে। হাতিরঝিল ভরাট করা হচ্ছে মূলত এই উড়ালসড়ক নির্মাণের অংশ হিসেবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ হাতিরঝিল ভরাটের বিষয়ে অনুমতি নেওয়ার দাবি করলেও রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সরকার অনুমোদিত প্রকল্প। এই প্রকল্পের কিছু পিলার হাতিরঝিল অংশে পড়বে, সেটার বিষয়ে তারা অনুমতি নিয়েছে। তবে হাতিরঝিল ভরাট করার কথা না।
মহানগরী, বিভাগীয় শহর, জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনের (২০০০) ৫ ধারা অনুযায়ী, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।
এর আগে জলাধার আইন লঙ্ঘন করে হাতিরঝিল ভরাট করে অবৈধভাবে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক রায়ে বিজিএমইএ ভবনকে ‘হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যানসারের মতো’ উল্লেখ করেন। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০২০ সালে বিজিএমইএ ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। এবার এই ভবনের জায়গার পাশেই নতুন করে চলছে হাতিরঝিল ভরাটের কাজ।
রাজউক হাতিরঝিলে কাজ করার বিষয়ে আইনি দিক পর্যালোচনা করেই অনুমতি দিয়েছে বলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে। এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সমন্বয়কারী মিসবাহিল মোকার রাবিন বলেন, এই অনুমতি পেতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। হাতিরঝিলের পানি প্রবাহে কোনো বাধা পাবে না। পিলার বসানোর কাজ শেষ হলে ভরাট অংশ খুলে দেওয়ার পাশাপাশি লেকের পাড়ের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করে দেবে এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, পিলার নির্মাণ শেষে হাতিরঝিলের উন্নয়নকাজের শর্ত রয়েছে। লেকের পাড় বাঁধাই করা হবে। নানা ধরনের বৃক্ষরোপণ করা হবে। হাঁটাপথ (ওয়াকওয়ে), পার্কের মতো গণপরিসর তৈরি করা হবে। এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অধীনে এসব কাজের জন্য আলাদা করে ব্যয় ধরা হয়েছে।
এক্সপ্রেসওয়ের পিলার বসানো শেষে লেকের সৌন্দর্যবর্ধনে কী কী করা হবে, সেগুলোর নকশা করেছে নকশাকারী প্রতিষ্ঠান ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ। হাতিরঝিল প্রকল্পের পরামর্শক ছিলেন ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, তারা হাতিরঝিলের মাঝখান দিয়ে পিলার নিতে চেয়েছিল। পরে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইস্কাটন অংশের পাড় দিয়ে পিলার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে পিলার বসানোর পরে কীভাবে গণপরিসর তৈরি করতে হবে, সেটির নকশা করা হয়েছে। হাতিরঝিল অংশে নিয়ম মেনে কাজ হচ্ছে কি না, সেটি দেখভাল করা জরুরি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষের কাজ দেখভাল করার দায়িত্ব রাজউক ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের।
রাজধানীর যানজট কমাতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়েছিল। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল সাড়ে তিন বছরে, যা ১২ বছর পার হওয়ার পরেও শেষ হয়নি। পুরো কাজ কবে শেষ হবে, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) নেওয়া প্রকল্পগুলোর একটি উড়ালসড়ক। এটি বাস্তবায়ন করছে সেতু বিভাগ।