‘কোন মেস্তরি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়…।’
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের রংবেরঙের এসব ‘ময়ূরপঙ্খি নাও’ যে সব সময় হাওরের জলে-ঢেউয়ে তুফান তোলে, তা নয়। যখন হাওরবাসীর মনে সুখ থাকে, তখন হাওরে নৌকাবাইচ হয়। জারি-সারিতে নেচে-গেয়ে আনন্দে মাতে মানুষ। তখন জলসা জমে হাওরে। এসব জলসায় হাসন রাজা, রাধারমণ, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিমের গানে তাঁদের প্রাণ জুড়ায়।
এই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পেছনের শক্তি হলো হাওরের বোরো ধান। এবার সুনামগঞ্জের কৃষকদের ঘরে বোরো ধান গোলায় তোলার সুখ আছে। তাই শুধু নৌকাবাইচ নয়, গ্রামে গ্রামে হবে ঐতিহ্যের দাওয়াতি কুস্তি খেলা, হাডুডু, প্রীতি ফুটবল, ষাঁড়ের লড়াই। বাড়ির উঠানে রাতবিরাতে বসবে মালজোড়, কেচ্ছা, পুঁথিপাঠের আসর। বিয়েশাদিসহ নানা রকমের আনন্দ আয়োজন থাকবে বছরজুড়ে।
এখন গানের জলসার সঙ্গে হাওরে বেশি আয়োজন হয় দাওয়াতি কুস্তি খেলার। এক গ্রামের মানুষ আরেক গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসেন। কয়েক শ মানুষের থাকা-খাওয়ার আয়োজন হয় দাওয়াতি গ্রামে। রাতে চলে আড্ডা-গান। এতে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য বাড়ে। অনেক সময় আত্মীয়তা, বিয়েশাদির সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
হাওর কখনো দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ। তখন বসন্ত বাতাসে দোল খায় সোনালি ধানের শিষ। হাওর আবার কখনো জলে ভাসা জনপদ। জল-জোছনার মেলবন্ধনে তখন নয়ন জুড়ায়। হাওরে যখন আফাল ওঠে, জীবন তখন উথালপাতাল ঢেউয়ের। জীবন এখানে কখনো সংগ্রামের, আবার কখনো বাউল সাধকদের মনমজানো গানের। হাওরে সুখ আছে, আছে দুঃখ। আছে প্রেম-বিরহের মধুর কাব্য। এ জনপদের মানুষ লড়তে জানে, ভেঙে আবার নিজেদের গড়তে জানে।
বলা হয়ে থাকে, ‘মাছ, পাথর আর ধান—সুনামগঞ্জের প্রাণ’। হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের মানুষের ‘মান’ যেন মিশে আছে হাওরের ধানে। এই ধানের ওপরই সুনামগঞ্জের চার লাখ কৃষক পরিবারের এক বছরের সংসার খরচ, সন্তানের লেখাপড়া, বিয়েশাদি, উৎসব-আনন্দ সব নির্ভর করে। যে বছর হাওরের বোরো ধান ঠিকমতো কৃষকের গোলায় ওঠে, সে বছর হাওর আনন্দে ভাসে। আর কোনো কারণে ফসল নষ্ট হলে হাওরের মানুষ যেন কষ্টের সায়রে ভাসে।
হাওরে বৈশাখজুড়ে চলে ধান তোলার উৎসব। এই উৎসব শেষ হয়েছে অতিসম্প্রতি। ধান গোলায় তোলার পর মানুষের তেমন কাজ থাকে না। তাই বর্ষায় থাকে নানা আনন্দ আয়োজন। এবার কৃষকের ঘরে ঘরে গোলাভর্তি ধান। সামনে তাঁদের আনন্দের দিন।
গত একটি মাস কৃষক পরিবারের মানুষ মাঠেই ছিলেন। পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই মিলে পরম আনন্দে ধান গোলায় তোলার কাজ করেছেন। ধান তোলার আনন্দের কাছে বৈশাখের তপ্ত রোদ কোনো পাত্তাই পায়নি। স্থানীয় মানুষ বলছেন, গত এক দশকের মধ্যে এবার সবচেয়ে নির্বিঘ্নে শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ধান গোলায় তুলতে পেরেছেন। কারণ, এবার অকালবন্যা, পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টির মতো কোনো দুর্যোগ ছিল না। ফলনও হয়েছে বেশ।
জেলার দেখার হাওরে একটি খোলায় ধান তোলার সময় কথা হয়েছিল স্থানীয় কৃষক আবদুল কাদিরের সঙ্গে (৫৫)। তিনি বলছিলেন, গত বছর ছেলের বিয়ের ইন্তেজাম করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ধান না পাওয়ায় সেটি আর হয়ে ওঠেনি। এবার ধান পেয়েছেন। বললেন, ‘আমরার ত ধানই সব।’ বর্ষায় ধুমধাম করেই হবে ছেলের বিয়ে।’
প্রতিবছর দাওয়াতি কুস্তি খেলার আয়োজন হয় শতাধিক, এবার দ্বিগুণ হবে। বলছিলেন নুরুল হক আফিন্দী, যিনি সুনামগঞ্জের ভাটি বাংলা কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি। তাঁর কথায়, ‘যে বছর মানুষ ধান পায়, সে বছর এসব আয়োজন বেশি হয়।’
দাওয়াতি কুস্তি তো হবেই। তার সঙ্গে এবার হাওরে গানের জলসাও হবে বেশি। জোছনা রাতে হাওরে দলবেঁধে বজরায় ভাসবে সুর–সুধায় কাতর আড্ডাবাজ মানুষ। দরাজ গলায় কেউবা গাইবে সুজন বন্ধুর গান। নিশি রাইতে হাওরের মৃদুমন্দ ঢেউ আর পুবালি হাওয়া ছাপিয়ে সেই গান, সেই সুর কারও কারও হৃদয়ে হয়তো তোলপাড় করবে।