সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তাদের ‘দায়িত্বহীনতা ও অবহেলা’র কারণে জঙ্গিবাদের মামলার আসামির জামিন হয়। বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেলের নজরে আনা হলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পিরপ্রেক্ষিতে কয়েকজনের জামিন স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। বাকিদের জামিন স্থগিতের প্রক্রিয়া চলছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের দুই আইন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজনের বেঞ্চ পরিবর্তন করা হয়েছে।
ওই বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষে দুই আইন কর্মকর্তা হলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম ফজলুল হক ও কামরুল আহসান খান আসলাম।
সম্প্রতি এসব আসামির জামিনের ঘটনা প্রকাশ হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দুর্ধর্ষ কোনো জঙ্গি আদালত থেকে জামিন পায়নি। যারা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছে কিন্তু মামলার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন বা চার্জশিট দাখিল হয়নি, এমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করে থাকেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিনউদ্দিন বলেন, জামিনের ঘটনা জানার পর সবগুলো স্থগিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আপিল বিভাগে তাদের জামিন স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই বেঞ্চের দু’জন ডিএজিসহ অন্যান্য বেঞ্চের আইন কর্মকর্তাদেরও দায়িত্ব পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে শুধু একটি ঘটনার জন্য পরিবর্তন নয়, বিভিন্ন কারণে আইন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পুনর্গঠন করা হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, জঙ্গিদের জামিন ঠেকানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। মামলা শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষকে অত্যন্ত সতর্ক থাকা উচিত। জেল থেকে বের হয়ে জঙ্গিদের ফের নাশকতার কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার নজির আছে।
রাজধানীর পল্লবী ও মানিকগঞ্জের শিবালয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০২১ সালের এপ্রিলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সক্রিয় দুই সদস্য সজীব হোসেন খান ও আব্দুল্লাহ জায়েদকে আটক করে র্যাব। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন উগ্রবাদী বই জব্দ করা হয়। পল্লবী থানায় করা মামলায় জায়েদকে গত ১১ জানুয়ারি জামিন দেন হাইকোর্ট। তাঁর আইনজীবী ফরহাদ আহমেদ জানিয়েছেন, জায়েদ দুই বছরের মতো কারাগারে রয়েছেন। এখনও তাঁর বিচার শুরু হয়নি। এ কারণে তাঁকে জামিন দিয়েছেন আদালত।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা সদরের হরিণমারী এলাকায় একটি বাড়ি থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দলের’ ছয় সদস্যক আটক করে র্যাব। আটকদের কাছ থেকে উগ্রবাদী বই ও লিফলেট এবং মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। এর মধ্যে দুই আসামি আব্দুল আজিজ বাবু ও বাবুল খন্দকারকে গত ১৫ জানুয়ারি জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
গত বছরের ২০ নভেম্বর ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ফটকে মারধর ও পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য আবু সিদ্দিক সোহেল ও মইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় ২০ জঙ্গির বিরুদ্ধে মামলা করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এ মামলার আসামি নাসির মিয়া ফারুক গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।
তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হলে তা মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া হরকাতুল জিহাদের সদস্য মাহফুজুর রহমান অপুকে গত ১৮ জানুয়ারি জামিন দেন হাইকোর্ট। ১৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি বাংলাভাইয়ের স্ত্রীও সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
জঙ্গি কর্মকাণ্ড গুরুতর অপরাধ হওয়ায় নিম্ন আদালতে তারা জামিন পায় না। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সব নাগরিককে জামিন দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে আদালতের। উচ্চ আদালত সার্বিক বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করে উভয় পক্ষকে শুনে জামিন দিয়ে থাকেন। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।
ঢাকা জজ আদালতের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগপত্র দাখিলেই বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় হাজতে থাকার পরেও যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় না, তারাই উচ্চ আদালত থেকে জমিন পেয়ে যায়।
জঙ্গিদের জামিন পাওয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম ফজলুল হক বলেন, ‘পেশাগত জীবনে এটা আমার জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অসতর্কতার কারণে জঙ্গি সম্পৃক্ততার সঙ্গে জড়িত আসামিরা জামিন পেয়ে গেছে। এখানে কোনো ধরনের অনৈতিক বা অসৎ কর্মকাণ্ড ঘটেনি।’
তিনি বলেন, অনেক আসামি আছে, তাদের কাছ থেকে লিফলেট উদ্ধারের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব ধারায় আসামিদের ছয় থেকে আট মাস বা এক বছরের সাজা হয়। কিন্তু দেখা যায়, আসামি দুই বছর ধরে কারাগারে আছেন। মামলার কোনো চার্জশিট হয়নি। সেসব আসামির ক্ষেত্রে জামিন বিবেচনা করেন আদালত।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সম্প্রতি বলেছেন, জামিন অযোগ্য অপরাধের মামলায় আসামিকে জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের ক্ষমতা অনেক বিস্তৃত হলেও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনস্বার্থসহ আনুষঙ্গিক আরও কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের এক সদস্যের জামিন বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে এ মত দেন আদালত।