সড়কে দুর্ঘটনায় জন্ম নেওয়া সেই ফাতেমার ঈদ

0
112
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরীর কোলো ফাতেমা, ছবি: সংগৃহীত

আট মাসের বেশি বয়সী ফাতেমার দাদা ঈদের আগে এসে দু-তিনটি নতুন পোশাক কিনে দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া নিবাসে অন্য যাঁরাই আসেন, তাঁরা বিশেষভাবে ফাতেমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন।

কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসের মেট্রন কাম নার্স তানিয়া সুলতানা।

গত জুলাইয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশালে কোর্ট ভবন এলাকায় সড়ক পার হতে গিয়ে ট্রাকচাপায় মারা যান জাহাঙ্গীর আলম (৪২), তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগম (৩২) ও তাঁদের ৬ বছর বয়সী মেয়ে সানজিদা। রত্নার মৃত্যুর আগে তাঁর পেট ফেটে সড়কেই জন্ম হয়েছিল ফাতেমার। আদালতের নির্দেশে আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসেই বড় হচ্ছে ফাতেমা। এবারের ঈদ সেখানেই কেটেছে বাবা-মাকে হারানো ফাতেমার।

ছোটমণি নিবাসের মেট্রন কাম নার্স তানিয়া সুলতানা বলেন, এবারের ঈদ নিবাসেই কাটছে ফাতেমার। বাড়ি ফিরলে নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁর ঈদ শুরু হবে। ফাতেমাসহ নিবাসের শিশুরা একটু আদর চায়, কোলে উঠতে চায়।

আজ সকালে গিয়ে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে ছোটমণি নিবাস বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। নিবাস সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়। প্লাস্টিকের ছোট ছোট স্লিপারসহ অন্যান্য খেলনায় শিশুরা আপনমনে খেলছে। খেলতে গিয়ে খুনসুটি হচ্ছে, আবার ভাবও হচ্ছে।

ছোট ছোট হাতগুলোতে মেহেদির নকশা করা হয়েছে। গায়ে লাল, নীল আর হলদে রঙের ঝলমলে জামা। পোলাও, না রোস্ট না ঝোল—এমন মিষ্টি মুরগির মাংস আর ডিম খেয়েছে। তবে কেন এ আয়োজন, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই তাদের। আট মাস থেকে ছয় বছর বয়সী ২৪টি শিশুর এত কিছু বোঝার মতো বয়সও হয়নি। খেয়েদেয়ে একসময় ছোট ছোট বিছানায় শুয়ে তারা ঘুমিয়ে গেল।

ছোটমণি নিবাসে থাকা শিশুদের ঈদ এভাবেই কেটেছে। স্বজনহীন, ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া, হারিয়ে যাওয়া অথবা আদালতের আদেশে অবুঝ এই শিশুদের ঠাঁই হয়ে সরকারের ছোটমণি নিবাসে।

ঈদের দিনে নতুন জামা পরেছে ছোটমণি নিবাসের শিশুরা
ঈদের দিনে নতুন জামা পরেছে ছোটমণি নিবাসের শিশুরা

ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম বলেন, ‘ঈদ বা অন্য কোনো বিশেষ দিন আলাদা করে তারা বুঝতে পারে না। সে বয়সও তাদের হয়নি। তবে আমরা চেষ্টা করি বিশেষ দিনগুলো উদ্‌যাপন করতে। তাই তো ঈদে বয়স অনুযায়ী খুঁজে খুঁজে ওদের জন্য নতুন ঝলমলে জামা কিনে দিয়েছি। ওদের হাতে মেহেদিও লাগিয়ে দিয়েছি। তাসনুভা আশা নামের একজন ওদের জন্য বিশেষ খাবার পাঠিয়েছিলেন, শিশুরা তা মজা করে খেয়েছে।’

ছোট্ট শিশুদের দেখভাল করা নিবাসে জনবলের এমনিতেই ঘাটতি আছে। ঈদের সময় অনেকেই ছুটিতে থাকেন বলে তা আরও কমে যায়। যে কর্মীরা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা নিজের পরিবার-পরিজন, সন্তান ফেলে এই শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন।

ছোটমণি নিবাসের সহকারী শিক্ষক লাভলী পারভীনের নিজেরও দুই বছর বয়সী সন্তান আছে। নিজের সন্তানকে বাসায় রেখে নিবাসের শিশুদের সঙ্গেই ঈদের দিন কাটিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘আমরা ছাড়া এই শিশুদের আর কেউ নেই। সকালে এখানে আসার পর মনে হয়েছে, ওরাই আমার সন্তান। এই শিশুরা রুটিন মতো চলে, গোসলের সময় গোসল করে। নতুন জামা পেলে অনেকে কাড়াকাড়ি করে কে কোনটা পরবে।’

নিবাসের শিশুদের ঈদ কেমন হচ্ছে, তা দেখতে সকালে নিবাসে গিয়েছিলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল। আর সন্ধ্যায় দেখতে যান পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী।

শিশুদের মধ্যে চকলেট বিতরণ করা হচ্ছে
শিশুদের মধ্যে চকলেট বিতরণ করা হচ্ছে, ছবি: সংগৃহীত

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে কামরুল ইসলাম চৌধুরী  বলেন, ‘আমি বাচ্চাদের জন্য চকলেট নিয়ে এসেছি। আমার সঙ্গে আমার কয়েকজন বন্ধু এসেছেন, তাঁরা বাসা থেকে সেমাই, পায়েসসহ বিভিন্ন খাবার এনেছেন। আমরা এই শিশুদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাব। বাচ্চারা সবাই ভালো আছে, আনন্দে ঈদ করেছে। ’

উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম বললেন, সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা এই শিশুদের ডায়াপার, খাবারসহ বিভিন্ন অনুদান দেয়। সবার চাওয়া একটিই—অসহায় এই শিশুরা ভালো থাকুক। ওরা যাতে একটি পরিবার পায়, বাবা-মায়ের আদর পায়, সে জন্য আদালতের অনুমতিতে নিবাসের শিশুদের দত্তক দেওয়া হয়। নিবাসে থাকা প্রতিটি শিশু যাতে আদর, স্নেহ, মায়া-মমতা পেয়ে বড় হতে পারে, সাধ্য অনুযায়ী সে চেষ্টাই করা হয়। ঈদের মতো বিশেষ দিনগুলো ঝলমলে করে তোলার চেষ্টা থাকে।

মানসুরা হোসাইন

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.