শ্রাবণ শেষের এই বর্ষায়………

0
108
বর্ষা উপভোগের। তবে উপভোগের এ আয়োজন একেকজনের একেক রকম। মডেল: মৌসুমী ও প্রিয়ন্তী

বর্ষা এবার নিয়ম ভেঙেছে। পাল্টে গেছে তার চিরচেনা রূপ। যখন আসার কথা, তখন আসছে না। পুরো আষাঢ় মাসেই তুমুল বৃষ্টির দেখা মেলেনি। বৃষ্টির বদল তীব্র তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ হয়েছে মানুষ। আর এই শ্রাবণের শেষ বেলায় এসে চোখ রাঙাচ্ছে বর্ষা। অনেকেই বলছেন, এসব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। যার প্রভাবেই দেরি হোক না কেন, বর্ষা এসেছে। যে সময় বর্ষা বুড়ো হয়ে চলে যাওয়ার কথা, ঠিক সেই সময়ে বর্ষা যেন শিশুর চরিত্রে অভিনয় করছে।

শিশু প্রথম কথা শেখার সময় কারণে-অকারণে একই শব্দ, একই কথা আধো আধো বোলে বারবার বলে যায়, ঠিক তেমনই বর্ষার এবার আর শ্রান্তি নেই। হঠাৎ কণ্ঠ খুলে গেছে তার। গত কয়েক দিন থেকে বর্ষা একই ঝমঝম-ঝিরিঝিরি সুর বাজিয়ে যাচ্ছে আধো আধো স্বরে। মধ্যে কিছুক্ষণের একটু বিরতি, তারপর আবার শুরু করে দিচ্ছে। বৃষ্টি যখন কথা শুরু করে দেয়, তখন মানুষের কথা কমে আসে। মানুষ তখন নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে। কথা বলে স্মৃতির সঙ্গে। এ ছাড়া বৃষ্টির অবিরাম পতনের সুর ঘুমকে নিবিড় করে তোলে। এভাবেই বর্ষাকে উপভোগ করে মানুষ।

বর্ষা উপভোগের। তবে উপভোগের এ আয়োজন একেকজনের একেক রকম। কেউ ঘুমিয়ে, কেউ গান শুনে, বই পড়ে আর কেউবা বৃষ্টিতে ভিজে এই বর্ষা উপভোগ করেন। তবে এ নগরজীবনে যাঁদের এই ঝুম বৃষ্টির সকালে বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি আধভেজা হয়ে অফিস বা কাজে যেতে হয়, তাঁদের বিষয় আলাদা। তাঁদের কাছে বৃষ্টি উপভোগের না হয়ে বিরক্তির হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু চাইলে তাঁরাও নানাভাবে এ বিরক্তি কমিয়ে বৃষ্টির আনন্দটা নিতে পারেন।

এই শ্রাবণের শেষ বেলায় এসে চোখ রাঙাচ্ছে বর্ষা। মডেল: মৌসুমী ও প্রিয়ন্তী
এই শ্রাবণের শেষ বেলায় এসে চোখ রাঙাচ্ছে বর্ষা। মডেল: মৌসুমী ও প্রিয়ন্তী

নৌকা ভাসাও জলে

এমন বরষায় বাড়ির সামনে থই থই বৃষ্টির পানি জমে থাকে। অন্তত একটা দিন স্মৃতির পিছু পিছু ফিরে যেতে পারেন শৈশবে। হাতের কাছে যে কাগজই পান না কেন তা দিয়ে নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিতে পারেন জমে থাকা জলে। কিছুক্ষণ দুলকি চালে চলা সেই কাগজের নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকুন।

তারপর দেখুন জাদুর মতো শৈশবের কত স্মৃতি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে হৃদয়। আর বাসায় যদি ছোট কেউ থাকে, তাকেও সঙ্গে নিতে পারেন। বৃষ্টি, নৌকা দেখা ও শৈশবের সাধ সেও পেয়ে যাবে। এই শহুরে জীবনে এই সব ছোটখাটো আনন্দ কম তো নয়!

বাইরে যদি যেতে হয়

এই ঝুম বৃষ্টির ভেতর বাইরে যদি যেতেই হয়, তাহলে ছোট পরিবার হলে সবাইকে নিয়ে বাসার আশপাশে কোথাও বেরিয়ে পড়ুন। এ ক্ষেত্রে ছোট ছাতা কাজে দেবে না। সঙ্গে বড় ছাতা নিতে হবে। সেই ছাতার তলে সবাই মিলে ঢুকে যেতে পারেন পাশের কোনো রেস্তোরাঁয়। খাওয়ার পাশাপাশি একটি ছোট্ট পারিবারিক আড্ডাও হয়ে যাবে তাতে। ঝুম বৃষ্টিই এনে দিতে পারে এমন পারিবারিক আড্ডার পরিবেশ।

ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে দল বেঁধে নিশ্চয়ই মাঠে খেলতে নেমেছিলেন
ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে দল বেঁধে নিশ্চয়ই মাঠে খেলতে নেমেছিলেন

অফিসফেরত বিকেলবেলা

এমন ঝমঝম বৃষ্টির ভেতর সকালে যদি বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে অফিসে বা কাজে যেতে হয়, তাহলে বিকেলটাকে আর ফাঁকি না দেওয়াই ভালো হবে। ভেজার আনন্দে ভিজতে থাকুন। ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরুন। দেখবেন, সব চাপ কিংবা বিষণ্নতা বৃষ্টির জলে কিছুক্ষণের জন্য ভেসে ভেসে যাচ্ছে দূরে।

ভেজার আনন্দ

ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে দল বেঁধে নিশ্চয়ই মাঠে খেলতে নেমেছিলেন। সেই স্মৃতি এখনো মনে উঁকি দিয়ে ওঠে। তাহলে ঘরে থাকলে তো অফুরন্ত সময়, আর অফিস গেলে বিকেলে কাছের বন্ধু কিংবা সমবয়সী বা ছোটদের সঙ্গে মাঠে নেমে যেতে পারেন। বৃষ্টিতে ভিজে একদিন খেলেই দেখুন, বড়বেলায় কীভাবে ফিরে আসে ছোটবেলার আনন্দ।

বর্ষার সুরে গানের মজলিশ

তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ মন এই স্নিগ্ধ শ্রাবণে এসে কোমল হয়ে যায়। কোমল মনে আত্মসমর্পণ করে গানের কাছে। বৃষ্টি দেখলে মানুষ নিজের অজান্তেই গুনগুনিয়ে ওঠে। ‘রেইন ড্রপস কিপ ফলিং অন মাই হেড’; ‘এল বরষা যে সহসা মনে তাই’; ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’; ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’; ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’ ছাড়াও বর্ষার অসংখ্য গান রয়েছে। বর্ষার প্রিয় গানগুলো মিউজিক সিস্টেমে এক জায়গায় রেখে চালু করে দিন। বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম ধ্বনি আর ঘরে ভেতর বৃষ্টির গান নিয়ে যাবে এক ভিন্ন জগতে।
পড়তে পড়তে দেখা

এই শ্রাবণ দিনে কোনো রোমাঞ্চ থ্রিলার নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে পড়ুন। দেখবেন দুপুর গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, তা টের-ই পাবেন না। বই পড়ার পাশাপাশি সিনেমাও দেখতে পারেন। রোমাঞ্চ থ্রিলার ছাড়াও বর্ষা নিয়ে বইগুলো পড়া যেতে পারে। বিমল মিত্রের লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ছাই’ বা বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ আবার পড়তে পারেন। পথের পাঁচালিতে বর্ষার অপূর্ব বর্ণনা রয়েছে, আছে বিষণ্নতাও। আবার সত্যজিৎ রায় সাবলীলভাবে এই দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমা বা হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ পড়া ও দেখা যেতে পারে।

বৃষ্টিতে ভিজে একদিন খেলেই দেখুন, বড়বেলায় কীভাবে ফিরে আসে ছোটবেলার আনন্দ
বৃষ্টিতে ভিজে একদিন খেলেই দেখুন, বড়বেলায় কীভাবে ফিরে আসে ছোটবেলার আনন্দ

রাঙিয়ে নিন নিজেকে

বৃষ্টি থেমে হঠাৎ একটু রোদ আবার একটু বৃষ্টি হলে সূর্যের উল্টো দিকে তাকিয়ে রংধনু খুঁজে দেখুন।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে জোড়া রংধনুর দেখাও মিলতে পারে। আর রংধনু চোখে পড়লেই দেখবেন, মনের অজান্তেই হেসে উঠেছেন আপনি।

আগেই বলেছি, বৃষ্টি যখন কথা শুরু করে দেয়, তখন মানুষ নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে। কথা বলে স্মৃতির সঙ্গে। এই সব স্মৃতির ভেতর নিজের আমিকে হাতড়ে বেড়ায়। একসময় উদাসীন হয়ে ওঠে মানুষ। মেঘদূতের উড়ে আসা মেঘের মতো হয়তো পাশ থেকে এই ঘন বর্ষায়ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়ে উঠবেন—‘শুধু ঝরে ঝরঝর আজ বারি সারাদিন/ আজ যেন মেঘে মেঘে হলো মন যে উদাসীন…।’

সুজন সুপান্থ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.