স্বাস্থ্যে নোবেল জয় আর বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণা

0
92

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ক্যাটালিন কারিকো এবং ড্রিউ ওয়াইজম্যান এ বছর এমআরএনএভিত্তিক টিকা আবিষ্কারের কারণে শারীরতত্ত্ব ও স্বাস্থ্যে নোবেল জয় করেছেন। ২০১৯-এর অতিমারি নিয়ন্ত্রণে আনার পেছনে কভিড-১৯-এর টিকা আবিষ্কার অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। এ কথা জানলে বিস্মিত হতে হয়, কারিকো নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এই এমআরএনএভিত্তিক টিকার কৌশলের কথা ভাবলেও মার্কিন সরকার এ খাতে অর্থায়ন করতে নারাজ ছিল! কারিকো তাঁর অগ্রজ ওয়াইজম্যানের সহযোগিতায় এমআরএনএর কারণে কোষে সৃষ্ট ইমিউন রেসপন্সের গবেষণায় লিপ্ত হন। সেই থেকে শুরু। কভিড-১৯ অতিমারির প্রায় দেড় দশক আগে, ২০০৫ সালে ‘সেল’ পত্রিকায় কারিকো, ওয়াইজম্যান এবং তাদের সহগবেষকরা রাসায়নিকভাবে রূপান্তরিত এমআরএনএর প্রভাবে পরিলক্ষিত ইমিউন রেসপন্সের উপাত্ত প্রকাশ করেন। বপন করা হয় আগামীর অতিমারি মোকাবিলার মহৌষধের বীজ।

কারিকো এবং ওয়াইজম্যানের নোবেল নিয়ে আরও জানতে পারেন পাঠক। তবে লেখাটির এই অংশে বিজ্ঞান গবেষণায় বাংলাদেশের অবস্থান এবং আমাদের গবেষণা সংস্কৃতির স্থিতি ও করণীয় নিয়ে মন্তব্য থাকছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন খাতে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে রয়েছে। এর ভেতর পারমাণবিক শক্তি কমিশন, পাট ও ধান গবেষণা কেন্দ্র এবং হালের ন্যানোটেকনোলজি ইনস্টিটিউটের উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পথে প্রতিবন্ধকতা তবে কী এবং কোথায়? বাংলাদেশে উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পাদনের সব উপঢৌকন উপস্থিত। বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে রয়েছে উঁচু মানের মেধা, সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্র এবং গবেষণা ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা। যেমনটি দেখা যায় জৈব পচনশীল সোনালি আঁশ পাট ফলনে আমাদের আধিপত্যে। বিজ্ঞান গবেষণার পথে যে বিষয়টি সুগঠিত নয় তা হলো, এ ক্ষেত্রগুলোর সমন্বয় এবং সরকারি প্রণোদনায় বিজ্ঞান গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিজ্ঞান গবেষণা প্রসারে কয়েকটি ধাপ জরুরি।

প্রথমত, সরকারি পর্যায়ে যে কোনো একটি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করতে হবে। যেখানে বাংলাদেশের উদ্ভাবন বিশ্বমানের সমকক্ষ হতে পারে। এটি হতে পারে কৃষিক্ষেত্রে উদ্ভাবন, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দক্ষতা ও আপেক্ষিক সুবিধা রয়েছে। উপযুক্ত ক্ষেত্র চিহ্নিত করা অতি জরুরি। পার্শ্ববর্তী দেশ, বিশ্বের ফার্মাসি নামে পরিচিত ভারতের অনুকরণে জৈব প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দিলে এ প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন হবে সুকঠিন। দ্বিতীয়ত, ক্ষেত্র চিহ্নিত হওয়ার পর আর্থিক জোগান জরুরি হয়ে দাঁড়াবে। সরকার এই জোগানদাতা হতে পারে, তবে শুরুর দিকে। আজন্ম এমন জোগান যে কোনো সরকারের পক্ষেই দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই গবেষণার পাইপলাইনের শেষ দিকে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংযুক্তি ও প্রণোদনা আবশ্যক। প্রশ্ন হচ্ছে, গবেষণাটি করবেন কে বা কারা? তাই তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অধ্যাপকদের পদোন্নতি ও মূল্যায়নে গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে প্রাধান্য দিতে হবে। পাশ্চাত্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শুধু জ্ঞান বিতরণই করে না, তারা নতুন জ্ঞান সঞ্চারের কারিগর হিসেবেও কাজ করে। পাশ্চাত্যে কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়ে আসছে ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে। এর কারণ, তাদের সংস্কৃতিতে প্রশ্ন করা কোনো অপরাধ নয়। তাদের সমাজে ‘আমি জানি না’– এই স্বীকারোক্তিতে কোনো লজ্জা নেই। তাই অজানাকে জানার পেছনে তাদের এক অদম্য বাসনা কাজ করে। সরকারযন্ত্র যদি সমাজে জ্ঞান তৈরির সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে, তবে পরবর্তী সময়ে সমাজের দায়িত্ব বর্তাবে এই চর্চাকে অব্যাহত রাখা। সর্বোপরি জ্ঞানক্ষেত্রের চারপাশ থেকে দেয়াল তুলে দিতে হবে। নিজ শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে জ্ঞান আহরণে উৎসাহ দিতে হবে। আজ যে প্রকৌশলী, তাঁকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষতার পাশাপাশি সাহিত্য ও ইতিহাসও পড়তে হবে। আজ যে অর্থনীতির ছাত্র, তাঁর দর্শন পড়ার মতো অনুসন্ধিৎসা থাকতে হবে।

বিজ্ঞানে নোবেল জয়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই বর্ণাঢ্য মিছিলের নেতৃত্ব বরাবরই দিয়ে এসেছে পাশ্চাত্য। হঠাৎ জাপান, চীন কিংবা ভারতের নাম উঠে আসে। নোবেলের জয়রথ আবার ছুটে চলে পশ্চিমের প্রশস্ত রাজপথে। এর কারণ পক্ষপাতদুষ্টতা নয়। এর কারণ বিজ্ঞানচর্চার সুপ্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি। এটি সত্য যে, বিজ্ঞান দর্শনের ইতিহাসে একটি ভাবনার ক্ষেত্রে অতি উৎসাহকে পক্ষপাত হিসেবে দেখিয়েছেন কার্ল পপার আর থমাস কুন। তবে এই চিন্তাগত পক্ষপাতেরও প্রয়োজন রয়েছে। এটি জ্ঞান সংস্কৃতির অংশ। জ্ঞান তৈরি এবং জ্ঞান বিতরণ এই দুয়ের সমন্বয় সংস্কৃতির ইট-কাঠ-পাথর। উষ্ণায়নের ফলে পরিবর্তিত বাস্তবতা যখন বাংলাদেশের সামনে ভয়াল একটি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তখন এই আগামী জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য যে আমাদেরই তৈরি হতে হবে। কারিকো এবং ওয়াইজম্যানের নোবেল জয় এটিই প্রমাণ করে, আজকের আবিষ্কার আগামীর সুরক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর। আবিষ্কারের সংস্কৃতিই কেবল পারে একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের ইশারা দিতে। নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন-এ পুরঃ, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.