স্কিন ব্যাংক চালু হলো বাংলাদেশে, দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত

0
13
‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি’তে স্কিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে

আগুনে পোড়া রোগীদের সেরে ওঠার জন্য কখনো কখনো একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে ত্বক প্রতিস্থাপন। এ জন্য সাধারণত নিজ ত্বকই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ‘মেজর বার্ন’, অর্থাৎ দেহ ব্যাপকভাবে পুড়ে গেলে সেটা কঠিন হয়ে পড়ে। ‘মেজর বার্ন’ মানে রোগীর দেহের ৩৫-৫০% বা আরও বেশি পুড়ে যাওয়া। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর নিজের সুস্থ চামড়া পোড়া অংশ সম্পূর্ণ ঢেকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয় না। আবার দ্রুত সময়ের মধ্যে শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ চামড়া দিয়ে ঢেকে দিতে না পারলে রোগীর দেহ থেকে দ্রুত পানি, লবণ, প্রোটিন এবং তাপ বেরিয়ে যায়। ফলে তৈরি হয় মারাত্মক ডিহাইড্রেশন, শক এবং সংক্রমণের ঝুঁকি। এ পরিস্থিতিতে দাতার চামড়া ব্যবহার করে পোড়া অংশ সাময়িকভাবে ঢেকে দিয়ে রোগীর জীবন বাঁচানো যেতে পারে।

এ লক্ষ্য নিয়েই গত ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে ‘স্কিন ব্যাংক’। অর্থাৎ ত্বক ব্যাংক। দগ্ধ রোগীদের অত্যাধুনিক চিকিৎসায় এটি যে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, তা বলা বাহুল্য। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি’তে এই স্কিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। ফলে গুরুতর পোড়া রোগীদের ক্ষতস্থানে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে চামড়া প্রতিস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

গুরুতর দগ্ধ হলে শরীর থেকে পানি, লবণ, প্রোটিন ও তাপ দ্রুত বেরিয়ে যায়। যদি পোড়ার পরিমাণ বেশি হয় এবং রোগীর শরীর থেকে চামড়া নেওয়া সম্ভব না হয়, তখন স্কিন ব্যাংক থেকে সংগৃহীত চামড়া প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে একদিকে যেমন রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কমে, তেমনি দ্রুত নতুন চামড়া তৈরিতেও সহায়তা করে।

—ডা. শাওন বিন রহমান, আবাসিক সার্জন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি

বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান এই স্কিন ব্যাংক উদ্বোধন করেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, পোড়া রোগীদের জীবন বাঁচাতে এবং মৃত্যুহার কমাতে এটি অত্যন্ত জরুরি ও কার্যকর পদক্ষেপ। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সহযোগিতায় বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অব বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি এই সেট আপ এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছে।

এক বিবৃতিতে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান জানান, ‘গুরুতর দগ্ধ হলে শরীর থেকে পানি, লবণ, প্রোটিন ও তাপ দ্রুত বেরিয়ে যায়। যদি পোড়ার পরিমাণ বেশি হয় এবং রোগীর শরীর থেকে চামড়া নেওয়া সম্ভব না হয়, তখন স্কিন ব্যাংক থেকে সংগৃহীত চামড়া প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে একদিকে যেমন রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কমে, তেমনি দ্রুত নতুন চামড়া তৈরিতেও সহায়তা করে।’

ইতিমধ্যে এই স্কিন ব্যাংক থেকে সংগৃহীত চামড়া প্রতিস্থাপন করে অনেক রোগীকে সারিয়ে তোলা হয়েছে। এরকমই একজন দুই বছর বয়সী শিশু হামিদা। শিশুটির মা রাবেয়া বেগমের ভাষ্যে জানা যায়, গরম পানিতে পুড়ে হামিদার দেহের ৪২ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে তার রক্তে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। এই রোগের নাম সেপ্টিসেমিয়া। এতে হামিদার ক্ষত থেকে ক্রমাগত রক্ত ও পুঁজ বের হচ্ছিল। তাই স্কিন ব্যাংক থেকে চামড়া সংগ্রহ করে হামিদার দেহে ৩৫২.৫ সেন্টিমিটার ত্বক প্রতিস্থাপন করা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কিন ব্যাংক ব্লাড ব্যাংকের মতোই স্বীকৃত। বহুদিন ধরেই কার্যকর চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে।

আট বছর বয়সী মরিয়ম নামে এক শিশুর চিকিৎসাতেও কাজে লেগেছে এই স্কিন ব্যাংক থেকে সংগৃহীত চামড়া। মরিয়মের দেহে প্রায় ৭৭৯ সেন্টিমিটার পোড়া অংশ এই সংগৃহীত চামড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ফলে তার অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।

এরকম আরও বহু রোগীকে সারিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে স্কিন ব্যাংক। সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় এ ধরনের রোগীকে সারিয়ে তুলতে এর ভূমিকা দিন দিন বাড়ছেই।

একজন সুস্থ ব্যক্তি জীবদ্দশায় একাধিকবার চামড়া দান করতে পারেন
একজন সুস্থ ব্যক্তি জীবদ্দশায় একাধিকবার চামড়া দান করতে পারেন

স্কিন ব্যাংক কি নিরাপদ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কিন ব্যাংক ব্লাড ব্যাংকের মতোই স্বীকৃত। বহুদিন ধরেই কার্যকর চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। এ প্রসঙ্গে স্কিন ব্যাংকের কো-অর্ডিনেটর ডা. মাহবুব হাসান এক বিবৃতিতে জানান, একজন সুস্থ ব্যক্তি জীবদ্দশায় একাধিকবার চামড়া দান করতে পারেন। পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও মৃত্যুর ৬ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব। সাধারণত পিঠ ও পা থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয়। আর চামড়া দানে আইনগত কোনো বাধা নেই এবং এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ।

বাংলাদেশে স্কিন ব্যাংকের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হলে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা অনেক সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধাও নেই। আর একজন ব্যক্তি তাঁর নিকটাত্মীয়কে সহজেই ত্বক দান করতে পারেন।

চামড়া দান করার আগে যা জানা প্রয়োজন

ডা. মাহবুব হাসানের বিবৃতিতে জানা যায়, সুস্থ ব্যক্তি জীবদ্দশায় চামড়া দান করতে চাইলে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে শরীরের নির্দিষ্ট অংশ অবশ করা হয়। তারপর বিশেষ ডার্মাটম যন্ত্রের সাহায্যে শরীরের সুবিধামতো স্থান থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এ জন্য দাতার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। তা ছাড়া ১৪ দিনের মধ্যেই সাধারণত শরীরে নতুন চামড়া তৈরি হয়ে যায়।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারির প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফোয়ারা তাসমীম বিজ্ঞানচিন্তাকে বলেন, ‘এমনকি আজকেও একজন রোগীর দেহে ত্বক প্রতিস্থাপন করেছি আমি। সাধারণত স্পাইনাল অ্যানেস্থেশিয়ার মাধ্যমে উরু বা দেখা যায় না, এরকম কোনো জায়গা থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয়। রোগীর নিজ দেহ থেকে তো করা হয়ই, দাতার দেহ থেকেও যত্নের সঙ্গেই চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এ জন্য দাতাকে সর্বোচ্চ ৫-৬ ঘণ্টা হাসপাতালে থাকতে হয়, তবে ভর্তি হতে হয় না বা রাতে থাকতে হয় না।’

উল্লেখ্য, সাধারণত কোমরের নিচের অংশে ‘স্পাইনাল অ্যানেস্থেশিয়া’ করা হয়। তবে রোগীর স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্নাকাণ্ডের আশপাশের যেকোনো অঞ্চলে অ্যানেস্থেটিক বা অবশকারক ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে শরীরের নির্দিষ্ট কোনো অংশের স্নায়ুগুলোকে অবশ করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকেই বলে স্পাইনাল অ্যানেস্থেশিয়া। এতে ত্বক সংগ্রহ সহজ হয়।

বর্তমানে এই ত্বক ব্যাংকে কী পরিমাণ ত্বক রয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. ফোয়ারা জানান, ‘প্রায় ৯ হাজার সেন্টিমিটার ত্বক এখন সংগ্রহে রয়েছে। একটু কম-বেশি হতে পারে, তবে এটা আশাজনক।’

তিনি জানান, ক্যাডাভার স্কিন গ্রাফট করা গেলে ত্বক সংগ্রহ আরও সহজ হয়ে যেত। ‘ক্যাডাভার স্কিন গ্রাফট’ মানে দাতার মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ থেকে ত্বক সংগ্রহ করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ত্বক দানের এই রীতি বহুল স্বীকৃত। বাংলাদেশেও হয়তো আইনিভাবে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে ত্বক দান আরও বাড়বে, ফলে বাঁচবে আরও বহু মানুষের জীবন।

ডা. ফোয়ারার ভাষ্যেও প্রকাশ পায় এই আশা। তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। তবে ঘটনাকেন্দ্রীক নয়, সার্বিকভাবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আরও বাড়ুক, এটাই আমরা চাই।‘

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে স্কিন ব্যাংকের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হলে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা অনেক সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধাও নেই। আর একজন ব্যক্তি তাঁর নিকটাত্মীয়কে সহজেই ত্বক দান করতে পারেন। পর্যাপ্ত দাতার অংশগ্রহণ থাকলে এটি দগ্ধ রোগীদের সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.