সোয়া চার ঘণ্টা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ শাহবাগ মোড় আটকে রেখে আজকের মতো কর্মসূচি শেষ করেছেন সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধীরা। দাবি আদায়ে আগামীকাল সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে আবারও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবিতে এই আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে এই কর্মসূচি পালন করছেন। তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিছিল–সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করছেন।
শাহবাগে আজকে বিকেল ৪টার পর অবরোধ শুরু হলেও তার কয়েক ঘণ্টা আগে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে অবস্থান নেন এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হওয়া ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর বিকেল ৪টার পর শাহবাগের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিল রেখে চাঁনখারপুল, নীলক্ষেত, তাঁতীবাজার, শেরেবাংলানগরসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি। বাস থেকে নেমে বহু মানুষ পায়ে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। অফিস শেষে ঘরমুখো মানুষ পড়েন বড় ভোগান্তিতে। বাড়তি চাপ তৈরি হয় মতিঝিল থেকে মিরপুর–উত্তরা পথে চলাচল করা মেট্রোরেলে। প্ল্যাটফর্মগুলোতে ট্রেনে উঠতে যাত্রীদের লম্বা লাইন ধরতে হয়।
শিক্ষার্থীরা রাত আটটার দিকে অবরোধ তুলে নেওয়ার পর শাহবাগ মোড় দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়। অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে আমরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘটের যে কর্মসূচি দিয়েছি, এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। পাশাপাশি “ব্লকেড” কর্মসূচি পয়েন্টে পয়েন্টে চলবে।’
আগামীকাল অবরোধের আওতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে নাহিদ বলেন, ‘আজ আমরা শাহবাগ থেকে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত গিয়েছি। আগামীকাল আমরা কিন্তু ফার্মগেট পার হয়ে যাব। আগামীকাল বিকেল সাড়ে তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে আমাদের জমায়েত হবে। আমরা আমাদের “ব্লকেড” কর্মসূচি পালন করব।’
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কোনো কিছুতে ভয় না পাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো আবাসিক হলে বাধা দেওয়া হলে আমাদের জানাবেন। আমরা সম্মিলিতভাবে সেই হল ঘেরাও করব।’
আন্দোলনে বিপুল সাড়া পাওয়ার কথা তুলে ধরেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কোটা বাতিলের আন্দোলনের যৌক্তিকতা আমরা ২০১৮ সালেই প্রমাণ করেছি। আমাদের আদালত দেখিয়ে লাভ নেই, আমরা আপনাদের সংবিধান দেখাচ্ছি। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী এবারও শিক্ষার্থীদের জনমতের পক্ষে সংসদে দাঁড়িয়ে কোটার বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহা দেবেন।’
শিক্ষার্থীদের ‘পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে’ দাবি করে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আর কোনো অপশন নেই। আমরা হয় দাবি আদায় করে ফিরব, নয়তো দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। মেধার মূল্যায়ন যেখানে নেই, সেই দেশে কেন মেধাবীরা থাকবে?’
নাহিদ ইসলামের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ বক্তব্য দেন। সন্ধ্যার দিকে এই দুই নেতা, নাহিদ ইসলাম ও আরেক নেতা আসিফ মাহমুদকে পুলিশ কর্মকর্তারা ডেকে নিয়ে কথা বলেন। ফিরে এসে তাঁরা বলেন, কোনো আপসে যাবেন না৷
২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। ওই বছর কোটা সংস্কার করে ১০ শতাংশ করার দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনে নেমেছিলেন। আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে পুরো কোটাব্যবস্থাই বাতিল করে। ওই বছরের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিলবিষয়ক পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পরে ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করেন। ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর ব্যানারে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পরিপত্র পুনর্বহালের পাশাপাশি আরও তিনটি দাবি জানাচ্ছেন। এগুলো হলো- ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে, সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে; সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না ও কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে; এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।